
নাফ নদ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার প্রাকৃতিক সীমারেখা। যার পানিতে জড়িয়ে আছে সীমান্তের রাজনীতি, অনিশ্চয়তা আর বেঁচে থাকার লড়াই। এ নদ একদিকে অনেক বাংলাদেশির জীবিকার উৎস, অন্যদিকে ভয় আর বিপর্যয়ের প্রতীক। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির আগ্রাসনে নাফ নদ এখন হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ। অস্পষ্ট সীমান্তের সুযোগে জেলেদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। তাদের কেউ ফিরছেন নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে, আবার অনেকে ফিরছেন না। উপকূলের ঘরে ঘরে কান্না আর অপেক্ষা না থামলেও প্রশাসন বলছে, সীমান্তের বাইরে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত অনেক জেলে পরিবার এখন অনিশ্চয়তায় বন্দি। কেউ হারিয়েছে স্বামী, কেউ ছেলে, কেউ পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে। সীমান্তের ধূসর বাস্তবতা, আরাকান আর্মির আগ্রাসন ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে নাফ নদ আজ মানবিক বিপর্যয়ের নীরব সাক্ষী।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ের তথ্যমতে, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে অন্তত ১১৬ জেলেকে আরাকান আর্মি অপহরণ করেছে। অন্যদিকে বিজিবির তথ্যমতে, চলতি বছরের ৯ মাসে ২৩৫ জেলেকে আটক করেছে আরাকান আর্মি। এর মধ্যে ১২৪ জন ফেরত এসেছেন। আটকা রয়েছেন আরও ১১১ জন, যাদের মধ্যে ৬২ জন রোহিঙ্গা।
জাহাঙ্গীর আলমদের মা ষাটোর্ধ্ব মদিনা বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘চারজনকে হারিয়ে দিন কাটে খেয়ে-না খেয়ে। সন্তানদের চিন্তায় আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। সারা দিন কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে, এখন ঠিকমতো কথাও বলতে পারি না। আমার একটাই দাবি, যে কোনো মূল্যে সন্তানরা যেন আমার কোলে ফিরে আসে।’
মো. আইয়ুব নামে আরেক জেলের ছেলে মো. সায়েম কালবেলাকে বলেন, ‘অর্থাভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।’
শাহপরীর দ্বীপের মো. ওসমান নামে এক বোট মালিকের ট্রলারসহ ১১ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। তারা হলেন আলী আহমদ (বাবা লালমিয়া), মোহাম্মদ আমিন (বাবা মোহাম্মদ রশিদ), ফজল করিম (বাবা মৃত আব্দুল করিম), কেফায়েত উল্লাহ (বাবা মৃত আব্দুল মজিদ), সাইফুল ইসলাম (বাবা সামশুল ইসলাম), কামাল হোসেন (বাবা মো. নুর রশিদ), মোহাম্মদ রাসেল (বাবা মোস্তাক আহমদ), মোহাম্মদ শোয়াইব (বাবা আব্দুর রহমান), আরিফ উল্লাহ (বাবা আব্দুর রশিদ), নুরুল আমিন (বাবা নুর আহমদ) ও মোহাম্মদ মোস্তাক (বাবা ফরিদ আলম)।
বোট মালিক মো. ওসমান কালবেলাকে বলেন, মাছ ধরা শেষে বোট নিয়ে জেলেরা ফিরছিলেন। শাহপরীর দ্বীপের জেটিঘাট থেকে হাত দেখিয়ে তিনি বলেন, বোট চলে আসছিল, ঠিক এমন সময় বাংলাদেশের সীমানা থেকেই ধরে নিয়ে গেছে।
কীভাবে খোঁজ পেয়েছেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওপারের কয়েকজন রোহিঙ্গা মুসলমানের সঙ্গে তার পরিচয় আছে। জান্তা সরকার যখন দমন-পীড়ন চালায়, তখন মিয়ানমার থেকে ওই রোহিঙ্গারা তার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে তারা দেশে ফিরে যান। এখনো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে জানিয়ে তাদের মাধ্যমেই খোঁজ নিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
শাহপরীর দ্বীপের সৈয়দ আলম নামে আরেক বোট মালিকের ট্রলারসহ ৬ জনকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। তারা হলেন ইমান হোসেন (বাবা মীর আহমদ), নুর আলম ও রশিদ আহমদ (বাবা কালু মিয়া), জাহাঙ্গীর আলম (বাবা মো. কালু) ও মনজুর আলম (বাবা কবির আহমদ)।
জানতে চাইলে সৈয়দ আলম কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ৮ বছর মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে সব সঞ্চয় দিয়ে এ বোট বানিয়েছি। আমার নতুন বোট, মাত্র দুই মাস পার হয়েছে। এর মধ্যেই ধরে নিয়ে গেল। এখন ৫টি জেলের পরিবারকেও আমাকে দেখতে হচ্ছে। আমার বিদেশ জীবনের কষ্টের সব উপার্জন শেষ।’
স্থানীয়দের তথ্যমতে, শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রিপাড়ার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রশিদ মিয়ার ছেলে সাইফুল ইসলামকে তিন জেলেসহ ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। জালিয়াপাড়ার পাঁচজন ও ডাউঙ্গাপাড়ার পাঁচজন দুটি বোটসহ আরাকান আর্মির হাতে আটক রয়েছেন বলে জানিয়েছেন শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দারা।
টেকনাফ পৌরসভার কেকে খালের ঘাটের ৯টি বোট আটক করে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। এসব বোটে সব মিলিয়ে ৬৫ জন জেলে ছিলেন, যাদের মধ্যে ৬১ জন রোহিঙ্গা। জানতে চাইলে টেকনাফ বোট মালিক সমিতির সভাপতি সাজেদ আহমদ কালবেলাকে বলেন, ‘টেকনাফের কেকে খালের ঘাটের ৯টি বোট ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। এসব বোটে ৬৫ জেলে ছিলন। তাদের মধ্যে ৬১ জন রোহিঙ্গা জেলে। তাদের কারও কোনো খোঁজখবর আমরা পাচ্ছি না, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব হচ্ছে না। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, যত দ্রুত সম্ভব আটক জেলেদের দেশে ফিরিয়ে আনা হোক।’ তিনি আরও বলেন, ‘অস্ত্রের মুখে জেলেদের অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। জেলেরা এখন নদীতে যেতে ভয় পান। এভাবে চলতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ করে দিতে হবে।’
সাজেদ আহমদ বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে নাফ নদের মিয়ানমার অংশে মাছ ধরায় এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে আরাকান আর্মি। তারা বাংলাদেশি জেলেদেরও মাছ ধরার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে। রাখাইনে খাদ্য সংকটের কারণে বাংলাদেশি জেলেদের নৌযান ও মালপত্র লুট করা হচ্ছে।’
সৌভাগ্যক্রমে আরাকান আর্মির হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন সেন্টমার্টিনের আরিফ নামে এক ব্যক্তি। আরিফ বলেন, ‘নদীতে জাল ফেলতে গিয়েছিলাম। আমরা আরাকান সীমান্তে ঢুকিনি, বাংলাদেশের অংশেই ছিলাম। এমন সময় আরাকান আর্মি স্পিডবোট নিয়ে আমাদের ধাওয়া করে। তখন জাল কেটে পালিয়ে আসি। আরাকান আর্মিকে দেখে প্রাণে পানি ছিল না।’
যা বলছে স্থানীয় প্রশাসন: জানতে চাইলে টেকনাফের ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘গত দুই মাসে ১১৬ জন জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। জেলেরা মূলত মিয়ানমার সীমান্তে গেলেই তাদের আটক করা হয়। এখন অন্য দেশের সমুদ্রসীমায় তো আমি যেতে পারি না। আমরা এ বিষয়ে জেলেদের সচেতন করছি এবং আটক জেলেদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমারের জলসীমায় মূলত মাছ বেশি পাওয়া যায়, যে কারণে জেলেরা ওই সীমানায় ঢুকে পড়েন।’
তবে আটক জেলেদের বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইলে ইউএনও তা দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘তালিকা করলে তো সংখ্যা আরও কম হবে। কারণ সবাই তো আটক হলেও আমার কাছে আসে না। এটি মৌখিক তথ্য।’ পরবর্তী সময়ে ইউএনওর কার্যালয় থেকে ১৩টি বোট মালিকের তথ্য দেওয়া হয়। সেখানে ১৩টি বোটে ৯১ জন জেলে আটকের বিষয়টি পাওয়া যায়।
মূল সমস্যা সীমানা চিহ্নিত না থাকা: মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশি জেলেরা কেন ঢোকেন—জানতে চাইলে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বেশ কয়েকজন বোট মালিক এবং জেলে কালবেলাকে বলেন, প্রথমত জেলেরা ভুলবশত ঢুকে পড়েন। সীমানা চিহ্নিত না থাকায় তারা বুঝতে পারেন না কোন সীমানায় আছেন। এ ছাড়া অনেক সময় জোয়ারের পানিতে ভেসে জেলেরা মিয়ানমারের সীমানায় চলে যান। আবার কেউ কেউ ঢোকেন স্বেচ্ছায়, কারণ মিয়ানমার সীমান্তে মাছ বেশি পাওয়া যায়।
তারা আরও বলেন, আকার অনুযায়ী একটি বোট নিয়ে সমুদ্রে গেলে তেল ও খাবার খরচসহ প্রায় ২০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। মাছ না পেলে লোকসানের অর্ধেকটা থাকে জেলেদের, বাকি অর্ধেক মালিকের। তাই মাছ না পেলে জেলেদের মাথা ঠিক থাকে না, তখন অনেক সময় তারা মিয়ানমার সীমানায় ঢুকে পড়েন।
Cox's Bazar Office: Main Road, Kolatli, Cox's Bazar, Bangladesh.
Ukhia Office: Main Road, Ukhia, Cox's Bazar, Bangladesh.
Email: shimantoshohor@gmail.com
© 2025 Shimantoshohor.com. All rights reserved.