ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার বাসিন্দা হাদিল সালেহ (২১)। বছরখানেক আগে গাজার আল-শিফা হাসপাতালের পাশের ভবনে চোখের সামনে ইসরায়েলি সেনারা তাঁর বাবা ও ভাইকে হত্যা করে। মিডল ইস্ট আইয়ের কাছে সেই মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এই তরুণী।
ছোট একটি ফ্ল্যাটবাড়ি। এর মধ্যে গাদাগাদি করে রয়েছে ক্ষুধার্ত আর আতঙ্কিত কয়েকজন মানুষ। এলাকা কাঁপিয়ে চলেছে ইসরায়েলি সেনাদের অবিরাম বোমাবর্ষণ।
হাদিল সালেহ ও তাঁর পরিবারের ৯ সদস্য ২০২৪ সালের মার্চ মাসের বেশ কয়েকটি দিন এভাবেই পার করছিলেন। গাজা নগরীর আল-শিফা হাসপাতাল ও আশপাশের এলাকায় সে সময় ইসরায়েলের সেনাদের তীব্র অভিযান চলছিল।
এরই মধ্যে একদিন আচমকা হাদিলদের বাড়িতে হানা দেয় কয়েক ডজন ইসরায়েলি সেনা। সৈন্যরা হাদিলের ৬০ বছর বয়সী বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর বড় ভাই বাবাকে সাহায্য করতে ছুটে গেলে সেনারা তাঁকেও গুলি করে মেরে ফেলে।
নৃশংস এ হামলার সময় ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। সৈন্যরা আশপাশের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায়। যারা বেঁচে যায়, তাদের পালাতে বাধ্য করে সেনারা।
ভয়ঙ্কর ওই হামলার এক বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু এখনো ওই ঘটনার বিভিন্ন সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে। ভয়াবহ সেই ঘটনা হাদিলকে এখনো মানসিকভাবে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যে বাসায় তাঁর বাবা ও ভাইকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে এখনো তিনি ফিরে যেতে পারেননি। বাসাটির বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি সে রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সেটা ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃস্বপ্নময় দিন।
আল-শিফা হাসপাতাল অবরোধ
হাদিল সালেহ বলেন, আরও আগে আরেকটি বোমা হামলায় তাঁদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এর জেরে যুদ্ধের প্রথম বছরে তাঁদের পরিবার একাধিকবার পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হয়।
হাদিলদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল ছিল আল-শিফা হাসপাতালের কাছে হাইদার আবদেল শাফি মোড়ের পাশের একটি অ্যাপার্টমেন্ট। তিনি বলেন, ‘আমরা খুবই কষ্টের মধ্যে ছিলাম। এটা ছিল আমাদের দশমবারের মতো গৃহহারা হওয়া। পবিত্র রমজান মাসে ওই ঘটনা ঘটেছিল। পর্যাপ্ত খাবার ছিল না। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের কিছুই প্রায় ছিল না।’
২০২৪ সালের ১৮ মার্চ নিশুতি রাতে ইসরায়েলি বাহিনী আল-শিফা হাসপাতালে বড় ধরনের অভিযান চালায়। এ সময় হাসপাতালের আশপাশের এলাকা লক্ষ্য করে তীব্র বিমান হামলা ও কামানের গোলাবর্ষণ করা হয়।
ইসরায়েলি সেনারা ট্যাংক ও সামরিক যান দিয়ে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। এরপর সৈন্যরা হাসপাতাল চত্বরের আশপাশের ভবনগুলোতে হামলা চালায়। তারা সামনাসামনি মানুষজনকে গুলি করে হত্যা করে, জীবিতদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করে।
সেই রাতের ঘটনার স্মৃতিচারণা করে হাদিল সালেহ বলেন, ‘রাত আড়াইটার দিকে প্রচণ্ড গুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। সেই সঙ্গে ছিল ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাংক ও যুদ্ধবিমানের গগণবিদারী আওয়াজ।’
হাদিল সালেহ ও তাঁর পরিবার ওই এলাকার অনেকের মতো কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। দিনের পর দিন তাঁরা ঘর থেকে বের হতে পারেননি। এলাকা ছেড়ে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
হাদিল বলেন, ‘সেই দিনগুলো ছিল অবর্ণনীয় কষ্টের। আমরা ইফতার করতে পারতাম না, নামাজ পড়তে পারতাম না। এমনকি অন্ধকারে একটা টর্চও জ্বালাতে পারতাম না। সব জায়গায় সেনারা চড়ে বেড়াচ্ছিল, ট্যাংকগুলোর ঘোরাঘুরি থামছিল না।’
টানা আট দিন লুকিয়ে থাকার পর ইসরায়েলি বাহিনী অবশেষে সেই ভবনে পৌঁছায়, যেখানে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন।
‘একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা’
২৬ মার্চ রাত তিনটার দিকে সাহ্রির প্রস্তুতির সময় হাদিল সালেহর পরিবার ইসরায়েলি বাহিনীর অতর্কিত হামলার মুখে পড়ে। দলে ৬০ জনের বেশি সেনাসদস্য ছিলেন।
হাদিল বলেন, ‘তারা সাউন্ড বোমা ও বিস্ফোরক দিয়ে ভবনে ঢোকার পথ উড়িয়ে দেয়। আমরা নিচতলায় ছিলাম। এরপর তারা আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের দরজাও উড়িয়ে দেয়। আমাদের কাউকে দেখতে পাওয়ার আগেই তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ভেতরে ঢুকে পড়ে।’
ওই সময় পরিবারের সবাই একটি অন্ধকার ঘরে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে ছিলেন। তাদের সঙ্গে আরেকটি ঘরহারা পরিবার ছিল, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন নারী ও শিশু।
সেখানে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে ছিলেন শুধু হাদিলের বাবা মোহাম্মদ সালেহ এবং তাঁর দুই ভাই বিলাল (২৮) ও সালাহ (১৮)। মুহূর্তের মধ্যে ইসরায়েলি সেনারা ঘরে ঢুকে পড়ে। তাঁর বাবা উঠে দাঁড়িয়ে সৈন্যদের বলতে চেষ্টা করেন যে তাঁরা বেসামরিক নাগরিক এবং তাঁদের সঙ্গে শিশুরাও আছে।
হাদিল সালেহ বলেন, ‘কিন্তু একটি কথাও বলার আগে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়। সেনারা তাঁর পেটে গুলি করেছিল।’
‘তারা (ইসরায়েলি বাহিনী) তারপর বিলালের পায়ে গুলি করে, পরে পেটে।’ হাদিল আরও বলেন, এরপর সালাহকে ঘরের এক কোনায় নিয়ে মারধর ও নির্যাতন করা হয়। মনে হচ্ছিল, তারা সালাহকেও হত্যা করার কথা ভাবছিল।
সালেহর বাবা-ভাইকে গুলি করে হত্যার পর ইসরায়েলি সেনারা বাসায় তল্লাশি চালায়। তখন একজন সৈন্যের নজরে আসে যে হাদিলের বড় ভাই বিলাল তখনো বেঁচে রয়েছেন। সেনাটি তখন আবারও বিলালকে গুলি করেন। হাদিল বলেন, সেনাটি তাঁর ভাইয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।
কয়েক মিনিট পর এক সেনাসদস্য ফিরে এসে তাঁদের বলেন, বাবা মারা গেছেন। হাদিল বলেন, ‘আমরা তখন হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করি।’ তখন সৈন্যটি চিৎকার করে বলেন, তিনি বিলালকেও মেরে ফেলেছেন। দুজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সৈন্যরা পরিবারটির কাছে জানতে চায়, তাঁরা কারা।
হাদিল বলেন, ‘এটাই সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ যে সৈন্যরা আমার বাবা ও ভাই সম্পর্কে কিছু না জেনেই তাঁদের ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করেছিল।’ তিনি আরও বলেন, তাঁরা যে বেসামরিক সাধারণ মানুষ, এটা কোনো বিবেচনাই ছিল না ইসরায়েলি সেনাদের কাছে।
‘রমাদান করিম’ (পবিত্র রমজান)
পরিবারের বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের ঘর থেকে বের হয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যাওয়ার আদেশ দেয় ইসরায়েলি সেনারা। নারীরা তাদের কাপড় পাল্টাতে চাইলে সৈন্যরা বলে তাদের সামনেই তা করতে হবে। নারীরা তাতে রাজি না হলে নামাজের পোশাকেই তাঁদের ঘর ছেড়ে বের হতে বাধ্য করা হয়।
হাদিল সালেহ বলেন, ‘চলে যাওয়ার আগে আমি বাবা ও ভাইয়ের মরদেহ কোথায় আছে জানতে চেয়েছিলাম। প্রশ্ন শুনে ইসরায়েলি সেনারা হেসে ওঠে। এরপর জোর করে আমাকে বের করে দেয়।’
হাদিল সালেহ আরও বলেন, ‘আমাদের বের করে দেওয়ার আগে ইসরায়েলি সেনা বলেছিল, তারা আমাদের ওপরের ফ্ল্যাটটা উড়িয়ে দেবে। বিস্ফোরণটি ছিল ভয়াবহ। বিস্ফোরণের পর তারা বিদ্রূপ করে বলেছিল, রমাদান করিম (পবিত্র রমজান)।’ প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলা বিভীষিকার পর পরিবারটি মৃতদেহ দুটি ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
ভোর ৫টা ১০ মিনিটের দিকে তারা আমাদের ঘর থেকে ঠেলে বের করে দেয়। আমরা একেবারে বিপর্যস্ত ছিলাম। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। এমন অবস্থায় অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে থাকি। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না,’ বলেন হাদিল।
পরিবারটি পথে পথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহ পার হয়ে যায়। পরে তারা পথ বদলে গাজা নগরের মধ্যেই থেকে যায়।
কয়েক দিন পর ১ এপ্রিল ইসরায়েলি বাহিনী আল-শিফা হাসপাতালে দ্বিতীয় বড় অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করে। টানা দুই সপ্তাহের এই অভিযানে শত শত মানুষ হতাহত হয়। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। হাসপাতাল চত্বর ও আশপাশের এলাকায় লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে।
২ এপ্রিল অভিযান শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর প্রিয়জনদের মৃতদেহ সংগ্রহ ও দাফন করতে বাড়িতে ফিরে যায় পরিবারটি। তবে তারা আর কখনো সেখানে বসবাস করতে ফিরে যায়নি।
Cox's Bazar Office: Main Road, Kolatli, Cox's Bazar, Bangladesh.
Ukhia Office: Main Road, Ukhia, Cox's Bazar, Bangladesh.
Email: shimantoshohor@gmail.com
© 2025 Shimantoshohor.com. All rights reserved.