নাছির, রেজাউলের পথে মেয়র শাহাদাতও। নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণের চুক্তি। চুক্তি বাতিলের দাবি।
চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যান নিয়ে আগের দুই মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর পথেই হাঁটতে যাচ্ছেন বর্তমান মেয়র শাহাদাত হোসেন। এই উদ্যানের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে নতুন করে নূর হাফিজ প্রপার্টিজ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২৫ বছরের জন্য চুক্তি করেছে সিটি করপোরেশন।
গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে হওয়া এই চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি উদ্যানে বিদ্যমান একতলা স্থাপনা বর্ধিত করে চারতলা পর্যন্ত করতে পারবে। এ ছাড়া বিনিয়োগের বিপরীতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ রয়েছে চুক্তিতে।
নতুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নতুন চুক্তিতে খোলা স্থানে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। আগের যে জায়গায় দোকান রয়েছে, সেখানে স্থাপনা করতে হবে। তবে এ জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনুমতি নিতে হবে।
গত বছরের ৩ অক্টোবর সিটি করপোরেশন আয়োজিত এক গণশুনানিতে বক্তারা বিপ্লব উদ্যানে নতুন করে কোনো স্থাপনা বা অবকাঠামো না করার বিষয়ে মত দিয়েছিলেন। তা উপেক্ষা করায় সিটি করপোরেশনের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন নগর–পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম ২ নম্বর গেট এলাকায় এক একর জায়গায় বিপ্লব উদ্যান গড়ে তোলা হয়।
এ নিয়ে গত সাত বছরে বিপ্লব উদ্যানের সৌন্দর্যবর্ধন ও উন্নয়নে তিনটি চুক্তি করেছে সিটি করপোরেশন। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন একটি এবং ২০২৩ সালের আগস্টে সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আরেকটি চুক্তি করেছিলেন। তবে আদালত উদ্যানে অবকাঠামো নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। আর এই চুক্তি চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি বাতিল করে সিটি করপোরেশন। এসব চুক্তির মাধ্যমে একসময়ের সবুজ উদ্যানটিতে ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছেন মেয়ররা।
গত বছরের ৩ অক্টোবর সিটি করপোরেশন আয়োজিত এক গণশুনানিতে বক্তারা বিপ্লব উদ্যানে নতুন করে কোনো স্থাপনা বা অবকাঠামো না করার বিষয়ে মত দিয়েছিলেন। তা উপেক্ষা করায় সিটি করপোরেশনের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন নগর–পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একদল গবেষকের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বিপ্লব উদ্যান কার্যত কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। এখানে কংক্রিট অবকাঠামোর পরিমাণ ৫৫ শতাংশ। অথচ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, উদ্যানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বেশি কংক্রিট অবকাঠামো থাকতে পারবে না। আর আন্তর্জাতিকভাবে ২ শতাংশও অনুমোদন করে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নগরের কোথাও উন্মুক্ত পরিসর, খালি জায়গা কিংবা বড় নালা দেখলেই সেখানে দোকান–মার্কেট করে ভাড়া দিতে জুড়ি নেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। বিপ্লব উদ্যান নিয়ে মেয়র শাহাদাত হোসেন ঠিক আগের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর খারাপ কাজগুলো অনুসরণ করছেন। এভাবে উদ্যানে স্থাপনার অনুমতি দেওয়া, বাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে নির্মাণাধীন অবকাঠামো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন মেয়র, যা পরে ভেঙে দেওয়া হয়।
নাছির-রেজাউলের পথে শাহাদাতও
গত বছরের ১১ নভেম্বর সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় বিপ্লব উদ্যান নিয়ে আগের মেয়রের আমলে করা চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় মেয়র শাহাদাত হোসেন জানান, বিপ্লব উদ্যানে বাণিজ্যিক স্থাপনার চেয়ে সবুজায়নকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। ওই বছরের ৭ নভেম্বর মেয়র শাহাদাত হোসেন বিপ্লব উদ্যান পরিদর্শনের সময় বলেন, এখানে কোনো নতুন স্থাপনা হবে না। রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে নির্মাণাধীন অবকাঠামো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন মেয়র, যা পরে ভেঙে দেওয়া হয়।
মেয়র শাহাদাত হোসেন বিপ্লব উদ্যান নিয়ে এমন ঘোষণা দিলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। নতুন চুক্তিতে বিদ্যমান একতলার ওপর আরও তিনতলা নির্মাণের সুযোগ রাখা হয়েছে। যদিও আ জ ম নাছির উদ্দীনের সময় দোতলা করা হলেও পরবর্তী প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন ওপরের তলা ভেঙে দিয়েছিলেন।
নগরে এমনিতেই সবুজ উদ্যান ও উন্মুক্ত পরিসর কমে যাচ্ছে। সেখানে সিটি করপোরেশন তা বৃদ্ধি না করে যেগুলো আছে, সেগুলো বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। বর্তমান মেয়রের সময়েও বিপ্লব উদ্যান সংকুচিত করে বাণিজ্যিকীকরণ করার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। সিটি করপোরেশনকে অবশ্যই এই ধরনের কার্যক্রম থেকে সরে আসতে হবে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপত্য ও নগর–পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান
নতুন চুক্তি অনুযায়ী, দ্বিতীয় তলায় নগরবাসীর ‘গুণগত’ সময় কাটানোর জন্য আধুনিক সবুজবান্ধব আরবান লাউঞ্জ নির্মাণ করা যাবে। তৃতীয় তলায় ইনডোর গেমসের জন্য কফিশপসহ একটা অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে। আরেক অংশে উন্মুক্ত স্থানে বিশ্রামের স্থানসহ কফিশপ থাকবে। চতুর্থ তলায় চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস–সংবলিত প্রদর্শনী কেন্দ্র করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
উদ্যানে বর্তমানে থাকা ২১টি দোকান ও ২টি শৌচাগার নতুন প্রতিষ্ঠানটির হাতে তুলে দেওয়া হবে। এখন দোকানমালিকদের নতুন করে চুক্তি করতে হবে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগের বিপরীতে প্রকল্প এলাকায় দেশি–বিদেশি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক প্রচার ও সহায়তা–সংক্রান্ত ডিজিটাল স্ক্রিন, এটিএম বুথ ও কিয়স্ক স্থাপন করতে পারবে। উদ্যানের খালি মাঠে ২১৫ ফুট দীর্ঘ ও ৫৪ ফুট প্রস্থের বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদলে অবকাঠামো করা যাবে। চারপাশে হাঁটার জন্য হাঁটাপথ বা ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। উদ্যানের সার্বিক কার্যক্রম তদারকির জন্য দেড় হাজার বর্গফুটের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘর নির্মাণ করা হবে। উদ্যানের পূর্ব পাশে ডিজিটাল স্ক্রিন, বিলবোর্ড, মেগা সাইন থাকবে। আগের দুই মেয়রের আমলে করা দুটি চুক্তিতেও প্রায় একই ধরনের শর্ত ছিল।
ব্যক্তিগত সফরে মেয়র শাহাদাত হোসেন বর্তমানে কানাডায় আছেন। তবে গত ২৩ জুন বাজেট অধিবেশনে সিটি করপোরেশনের মেয়র দাবি করেন, বিপ্লব উদ্যানে নতুন করে কোনো দোকান নির্মাণ করা হবে না। তবে আগে থাকা দোকানগুলোতে মাত্র এক লাখ টাকা পেত সিটি করপোরেশন। এখন পাবে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা।
এদিকে বিপ্লব উদ্যানে নতুন করে কোনো স্থাপনার অনুমোদন না দিতে সিডিএ চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বিপ্লব উদ্যান দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন বিপ্লব উদ্যানে আর কোনো নতুন স্থাপনা করা হবে না। কিন্তু এখন চারতলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছেন, যা খুবই হতাশাজনক।
সিটি করপোরেশনের নতুন চুক্তি নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপত্য ও নগর–পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগরে এমনিতেই সবুজ উদ্যান ও উন্মুক্ত পরিসর কমে যাচ্ছে। সেখানে সিটি করপোরেশন তা বৃদ্ধি না করে যেগুলো আছে, সেগুলো বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। বর্তমান মেয়রের সময়েও বিপ্লব উদ্যান সংকুচিত করে বাণিজ্যিকীকরণ করার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। সিটি করপোরেশনকে অবশ্যই এই ধরনের কার্যক্রম থেকে সরে আসতে হবে।’
Cox's Bazar Office: Main Road, Kolatli, Cox's Bazar, Bangladesh.
Ukhia Office: Main Road, Ukhia, Cox's Bazar, Bangladesh.
Email: shimantoshohor@gmail.com
© 2025 Shimantoshohor.com. All rights reserved.