‘ছেলে বিকেলে বলল, আম্মা, একটু পর বের হব, কাছেই যাব, মাগরিবের পর ফিরে আসব। আমি আসরের নামাজে বসলাম। নামাজ পড়তে পড়তে সে নেমে গেল। নামাজ শেষ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, ছেলে বাইকের পেছনে উঠেছে। তখন বুঝলাম দূরে কোথাও যাচ্ছে। আমার তামিম...।’
রুমা আকতার আর কিছু বলতে পারলেন না। গতকাল রোববার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের মাইলের মাথা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় সত্যি সত্যিই দূরে চলে গেছে মায়ের আদরের ছেলে আতাউর রহমান তামিম। বন্ধু সাফায়েতের মোটরসাইকেলে চড়ে পতেঙ্গার দিকে যাচ্ছিল উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র আতাউর। সিএনজিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় ছিটকে পড়ে দুজন। ঘটনাস্থলেই মারা যায় তামিম। সামান্য আহত হয় সাফায়েত।
আতাউর রহমানরা দুই ভাই ও দুই বোন। দুই বোনের পর আতাউরের জন্ম। ভাইদের মধ্যে বড় আতাউর, তাই পরিবারে তার জন্য ছিল বাড়তি স্নেহ। ছেলে ঘর থেকে বের হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই দুর্ঘটনায় পড়েছে বলে ফোন আসে চান্দগাঁওয়ের বাসায়। ওপার থেকে পুলিশ তাঁদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বলে। তখনো আতাউরের মৃত্যুর কথা ভাবেননি তার পরিবারের সদস্যরা। একবুক আশা নিয়ে চমেক জরুরি বিভাগে ছুটলেন আতাউরের বাবা নিজামুল ইসলাম, মা রুমা আকতারসহ স্বজনেরা। সেখানে যে লাশঘরে তাঁদের ছেলে নীরব–নিথর পড়ে রয়েছে।
আজ (রোববার) আশুরা। সবাই বাসায় ছিলাম। বিকেলে সে বের হলো। প্রতিদিন মাগরিবের সময় কিংবা মাগরিবের পরপর ফিরে আসে। আজ বের হওয়ার ঘণ্টাখানেকের ভেতর ফোন এল, ছেলে দুর্ঘটনায় পড়েছে। তারপর দৌড় দিলাম। আমার ছেলে আল্লাহর কাছে চলে গেছে।
নিজামুল ইসলাম, আতাউরের বাবা
লাশঘরের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন রুমা। ‘আমার ছেলে, আমার তামিম’ বলে আর্তনাদ করছিলেন তিনি। নামাজের আগে ছেলের সঙ্গে বলা কথা যে শেষ কথা হলো, সেটিই বারবার আওড়াচ্ছিলেন। আত্মীয়স্বজন তাঁকে বারবার সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কী আর সান্ত্বনা! সন্তানের পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার বিপরীতে সব সান্ত্বনাই যে অতি তুচ্ছ।
বাবা নিজামুল ইসলাম একবার লাশঘরে যান তো একবার জরুরি বিভাগের সামনে। তাঁর পাঞ্জাবিতে রক্তের দাগ লেগে আছে। লাশঘরে ছেলেকে জড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছেন তিনি। পাঞ্জাবির এ দাগ যেন তাঁর অতি আপন আজ। নিজামুল বললেন, ‘আজ (রোববার) আশুরা। সবাই বাসায় ছিলাম। বিকেলে সে বের হলো। প্রতিদিন মাগরিবের সময় কিংবা মাগরিবের পরপর ফিরে আসে। আজ বের হওয়ার ঘণ্টাখানেকের ভেতর ফোন এল, ছেলে দুর্ঘটনায় পড়েছে। তারপর দৌড় দিলাম। আমার ছেলে আল্লাহর কাছে চলে গেছে। কারও প্রতি আমার অভিযোগ নেই।’
আতাউরের ছোট ভাই তাওফিকও এসেছে হাসপাতালে। একপর্যায়ে ক্রন্দনরত মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাওফিক। সান্ত্বনা দিল। মায়ের মন কি আর মানে? তাওফিকও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না তার বড় ভাই নেই। জরুরি বিভাগের পাশে চেয়ারে বসে নিজের কান্না লুকাতে ব্যস্ত স্কুলছাত্র তাওফিক।
আতাউর রহমান তামিম হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের (দ্বিতীয় বর্ষ) ছাত্র ছিল। সারাক্ষণ বন্ধুবান্ধব নিয়ে তার ওঠাবসা। কলেজ ও কোচিংয়ের বাইরে কখনো ফুটবল, কখনো ক্রিকেট, আবার কখনো দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া—এটাই ছিল তার নিত্যকার রুটিন। চমেক জরুরি বিভাগ ভরে গেছে তার বন্ধু–সুহৃদদের ভিড়ে। কলেজের বন্ধু, কোচিংয়ের বন্ধু, খেলার বন্ধু—হাহুতাশ করছে সবাই।
কোচিংয়ের বন্ধু শাহরিয়ার নিলয় চট করে মুঠোফোন থেকে দুই দিন আগের ছবি বের করে দিল। তারা ফুটবল খেলতে গিয়েছিল টার্ফে। খেলা শেষে সবাই মিলে ছবি তুলেছিল। শাহরিয়ারের কাছে এ ছবি সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি আজ, ‘কীভাবে বিশ্বাস করব তামিম নেই। ছবি যে এখনো কথা বলছে।’ বন্ধুদের এমন টান উপেক্ষা করে আতাউরকে নিয়ে শবগাড়ি গতকাল রাত ১১টার দিকে রওনা হলো গ্রামের বাড়ি বাঁশখালী পৌর এলাকার উদ্দেশে। তার শেষশয্যার পেছনে শত বন্ধু–স্বজনের ভালোবাসার হাতছানি।
Cox's Bazar Office: Main Road, Kolatli, Cox's Bazar, Bangladesh.
Ukhia Office: Main Road, Ukhia, Cox's Bazar, Bangladesh.
Email: shimantoshohor@gmail.com
© 2025 Shimantoshohor.com. All rights reserved.