কক্সবাজারের বিশ্বখ্যাত সমুদ্রসৈকতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দখল এবং অবৈধ দোকান বসানোর পেছনে বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও কার্ড বাণিজ্যের বিস্ফোরক অভিযোগ উঠেছে। পরিবেশবাদী ও স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দাবি, বিদায়ী ডিসি ক্ষমতার শেষ সময়ে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিলে সৈকতের ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’-এ ৩০০টিরও বেশি দোকানের অনুমতি দিয়ে ৯ কোটি টাকারও বেশি ঘুষ বাণিজ্য করেছেন।
পর্যটন শহর কক্সবাজারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে শুক্রবার গভীর রাতে রাতারাতি গড়ে তোলা হয় শতাধিক দোকান। সৈকতের বালিয়াড়িতে স্থাপিত এই দোকানগুলো সবই একই রঙ ও নকশায় নির্মিত, যেন পরিকল্পিতভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ বাজার বসানো হয়েছে। অথচ সরকার ১৯৯৯ সালেই কক্সবাজার সৈকতকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (Ecologically Critical Area – ECA) হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০১৭ সালে হাইকোর্ট জোয়ার-ভাটার রেখা থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত এলাকায় যেকোনো ধরনের স্থাপনা নিষিদ্ধ করে আদেশ দেয়।
কিন্তু এসব আইন ও নির্দেশনা এখন যেন কাগুজে দলিল মাত্র। বাস্তবে সৈকতের পরিবেশ ধ্বংস করে, বালিয়াড়ি কেটে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দোকান বসিয়ে চলছে দখল ও দুর্নীতির মহোৎসব। যার পেছনে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ।
পরিবেশবাদী সংগঠন “সেভ কক্সবাজার বীচ”-এর আহ্বায়ক করিম উল্লাহ বলেন, “বিদায়ী ডিসি মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের মেয়াদের শেষদিকে হঠাৎ করেই ৩০০টি নতুন দোকান কার্ড অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রতিটি কার্ডের জন্য গোপনে ৩ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে, যার মোট অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ৯ কোটি টাকা। এই কার্ড বাণিজ্যে রাজনৈতিক নেতারা এবং প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাও ভাগ পেয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, “যখন আমরা হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলাম, তখন লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিল। কয়েক দিনের মধ্যে আবার দোকান বসে যায়। এবার তো ব্যাপারটা পুরোপুরি লাগামহীন। বিদায়ী ডিসির সময়েই সব কিছু গোপনে চূড়ান্ত হয়।”
এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক মহলেও গুঞ্জন রয়েছে, ডিসির ‘শেষ ইনকাম’ হিসেবে কার্ড বাণিজ্যকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। নতুন জেলা প্রশাসক এখনো যোগদান না করায় প্রশাসনিক শূন্যতার সুযোগে সিন্ডিকেট পুরো সৈকত দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আলোচিত দুই ব্যক্তি—জাকির হোসেন ও নূরুল হুদা ওরফে গুরামিয়া—এই দখল প্রক্রিয়ার মূল নিয়ন্ত্রক। এরা দীর্ঘদিন ধরে একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় সৈকতে বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার করে আসছেন।
সুগন্ধা ঝিনুক মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জয়নাল উদ্দিন বলেন, “রাতের অন্ধকারে দোকান বসানো হয়েছে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে। কারও প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল না। প্রশাসনের কেউ না থাকলে কি এমন কাজ সম্ভব?”
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের ভাষ্যমতে, কেউ দোকান বসানোতে বাধা দিতে গেলে ভয় দেখানো হয়েছে, এমনকি গুলির ভয়ও দেখানো হয়েছে। পুরো ঘটনাটিই পরিকল্পিত এবং প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় সংঘটিত।
হাইকোর্ট ২০১৭ সালে জোয়ার-ভাটার রেখা থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত এলাকায় যেকোনো ধরনের স্থাপনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল। এই রায়ের বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা-র পক্ষ থেকে বারবার নোটিশ দেওয়া হলেও জেলা প্রশাসন সময়ক্ষেপণ করে এসেছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের একটি নোটিশ দেওয়া হলে ডিসি মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন সাময়িকভাবে কয়েকটি অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার সেই জায়গায় দোকান ফিরে আসে। এবারো সেই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে—তবে অনেক বড় পরিসরে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (ঢাকা অঞ্চল) এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এই ধরনের দখল ও অবকাঠামো সৈকতের জন্য শুধু ক্ষতিকর নয়, ভয়াবহ। বালিয়াড়ি হলো প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ। এগুলো কেটে দোকান বসানো মানে উপকূলকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মুখে ফেলে দেওয়া।”
জেলা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আজিম খান বলেন, “আমরা ঘটনাটি তদন্ত করছি। কার্ডধারীরা বৈধ কিনা তা যাচাই করা হচ্ছে। কিন্তু পরিষ্কারভাবে বলছি, অনুমতিপত্র থাকলেও বালিয়াড়ি দখল করা যাবে না।”
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহেদুল আলম বলেন, “আমরা খুবই বিব্রত। এত বড় দখল কার্যক্রম রাতারাতি হয়ে যাবে—এটা কল্পনাও করিনি।”
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, “সৈকতের বালিয়াড়ি কোনোভাবেই দখল করা বা দোকান বসানো সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে জানাচ্ছি।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৈকতের বালিয়াড়ি হলো সাগরের ঢেউয়ের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক ঢাল। এটি ধ্বংস হলে ভবিষ্যতে কক্সবাজার শহরসহ আশপাশের এলাকা জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে পড়বে।
পরিবেশ আন্দোলনকর্মী দীপক শর্মা দীপু বলেন, “এখানে দোকান বসানো মানে শুধু একটা স্থাপনা বসানো নয়, বরং গোটা উপকূলীয় পরিবেশ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। কক্সবাজারের বালিয়াড়ি ধ্বংস মানেই বাংলাদেশের উপকূলীয় নিরাপত্তা ধ্বংস।”
সৈকতের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে—এত স্পষ্ট আইন লঙ্ঘন, আদালতের নির্দেশনা অমান্য, কোটি টাকার দুর্নীতি—তবুও কেন প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না?
এই পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে জবাব চেয়েছেন সচেতন মহল। তারা বলছেন, রাষ্ট্র যদি নিজেই তার সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কক্সবাজার নয়, দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রও একই পরিণতির শিকার হবে।
বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার শুধু একটি পর্যটন গন্তব্য নয়, এটি বাংলাদেশের পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের একটি প্রতীক। অথচ দুর্নীতি, দখলদারিত্ব ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে সেই প্রতীক আজ চরম হুমকির মুখে।
Cox's Bazar Office: Main Road, Kolatli, Cox's Bazar, Bangladesh.
Ukhia Office: Main Road, Ukhia, Cox's Bazar, Bangladesh.
Email: shimantoshohor@gmail.com
© 2025 Shimantoshohor.com. All rights reserved.