দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। অনেক সময় রাজনৈতিক দল বা কোনো গোষ্ঠীর মাধ্যমে নির্যাতন বা হত্যার শিকারও হচ্ছেন সাংবাদিকরা। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সাংবাদিক নির্যাতনের এমন ঘটনাগুলো বারবার সামনে তুলে ধরলেও প্রতিকারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিগত আওয়ামী স্বৈরশাসনের সময় সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা যেমন বেড়ে যায়, তেমনি অনেক সাংবাদিক হত্যারও শিকার হন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এ সম্পর্কিত ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ১৪৭ জন সাংবাদিক আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও এর সমর্থকদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন ২১ জন। সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা নির্যাতন ও হুমকির শিকার হয়েছেন ৬৯ জন। এছাড়াও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ৬ জন সাংবাদিককে।
আসকের পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ২২ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা চালিয়েছে। একই সময়ে বিএনপির দ্বারা কোনো সাংবাদিক নির্যাতিত হননি। সরকারি কর্মকর্তারা হামলা চালায় ১ জনের ওপর। ওই সময় মরদেহ উদ্ধার করা হয় ১ জনের এবং অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ১ জনের।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের হামলার শিকার হয়েছেন ২৫ জন, বিএনপির দ্বারা নির্যাতিত হয় ১ জন। সরকারি কর্মকর্তারা নির্যাতন করে ১০ জনকে। ওই বছর হত্যা করা হয় এক সাংবাদিককে।
২০২১ জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মারধর করে ১৩ জন সাংবাদিকে। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দ্বারা নির্যাতিত হন ১৪ জন। হেফাজতে ইসলামের ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতালের সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন ১৩ জন।
২০২২ জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা হামলার শিকার হন ২৯ জন সাংবাদিক। একই সময়ে বিএনপি হামলা চালায় ৮ জনের ওপর। এ ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী নির্যাতন করে ১৪ জনকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ১ জন।
২০২৩ জানুয়ারি মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের হামলা, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছে ৩৩ জন সাংবাদিক। একই সময়ে বিএনপি নির্যাতন চালায় ৮ জন সাংবাদিককে। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী নির্যাতন করে ২২ জনকে। এছাড়াও পিটিয়ে হত্যা করা হয় একজনকে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা হামলা করে ২৫ জন সাংবাদিককে। তবে এ সময়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ৪ জনের ওপর হামলা-নির্যাতন চালায়। সরকারি কর্মকর্তা হামলা চালায় ৮ জনকে। এছাড়াও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তথ্য সংগ্রহের পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে গুলি করে হত্যা করা হয় ৬ জন সাংবাদিককে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা সাংবাদিকদের ওপর হামলা-নির্যাতন চালায় তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে। যদি হামলাকারীরা রেহাই পেয়ে যায় তাহলে তারা এভাবে সাংবাদিকদের ওপর হামলা-নির্যাতন চালাতেই থাকবে।
২০২৪ সালের শুক্রবার (২৮ জুন) রাতে হামলার শিকার হন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের নিউজরুম এডিটর শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ওইদিন রাতে আমি একটি লাগেজ নিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। এ সময় দুই-তিনজন মিলে আমাকে বলে আমার লাগেজে লাশ আছে! এ নিয়ে তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হলে তারা এক পর্যায়ে আমার ওপর হামলা চালায়। পরে তাদেরকে সাপোর্ট দেয় ওই এলাকার তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
তিনি বলেন, হামলার পর থানায় অভিযোগ দিলে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনার দিন থেকে শুরু করে আসামি গ্রেপ্তার করা পর্যন্ত আমার খোঁজ খবর নিয়েছিলেন।
তোষামোদকারী কিছু সাংবাদিকের কারণে শেখ হাসিনার দলীয় নেতাকর্মীরা অন্য সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানোর সাহস পেতো বলে মনে করছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি আবু সালেহ আকন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে সাংবাদিকদের প্রতি অত্যাচার ও নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটেছে। একদিকে, যারা সঠিক সাংবাদিকতা করতেন তাদের ওপর সরকার এবং তার প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিপীড়ন ও হামলা চালাতেন। অপর দিকে একদল সাংবাদিক ছিল শেখ হাসিনার খায়ের খা, তার তোষামোদকারী। এই তোষামোদকারীদের জন্যই সাংবাদিকদের ওপর এই হামলার সুযোগ পেয়েছে। যারা তোষামোদ করতো তারা শেখ হাসিনার খুব কাছাকাছি ছিল এবং তারা নীতি বিবর্জিত ছিল। তাদের কারণেই শেখ হাসিনা এতো বড় দানব হয়েছে, হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আর অপরপক্ষে যারা সঠিক সাংবাদিকতা করতো তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
আবু সালেহ আকন বলেন, সরকার যদি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে চায় তাহলে সদিচ্ছা থাকতে হবে। সদিচ্ছা যদি থাকে তাহলে নিরাপত্তা দিতে পারবে। আর যদি সে মনে করে যে, না সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বাদ থাক, সাংবাদিকরা নির্যাতিত হোক, এতে সরকারের কিছু যায় আসে না তাহলে সেটা হচ্ছে ভিন্ন কথা। সাংবাদিকদের নির্যাতন বন্ধ করতে বাড়তি কোনো আইনের দরকার নেই। দেশে যে ফৌজদারি আইন আছে এই আইনেই সাংবাদিক হত্যা এবং নির্যাতনের বিচার করতে পারে। সেটাও তো হচ্ছে না। যেমন সাগর-রুনির হত্যার যে ঘটনা ঘটেছে- আজ পর্যন্ত আমার সেই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনটাই পাই নাই। এখন আবার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার মেয়াদ নতুন করে বাড়ানো হয়েছে। এটা দুঃখজনক। আওয়ামী লীগের আমলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমরা দেখেছি- বিশেষ করে সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে, সেভাবে চলতে থাকলে তো সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হবেই। আর যদি দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়। তখন কেউ আর কোনো সাংবাদিকের ওপর হামলা করবে না এবং কোনো সাংবাদিককে নির্যাতনও করবে না।
তিনি বলেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলার কারণে দেশে কিছুটা বাকস্বাধীনতা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। লেখার স্বাধীনতা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। যেমন কিছু প্রকাশ করতে গেলে তারা হামলার শিকার হয়। সেক্ষেত্রে তাদের মধ্যে তো ভীতি আতঙ্ক কাজ করবে। সেই ভীতি আতঙ্কের জায়গা থেকে তারা অনেক সময় সত্য গোপন করে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মফিজুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে সবসময় সাংবাদিকরা আক্রান্ত হয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় যদি বিচার না হয় তাহলে যারা হামলা করে তারা দায়মুক্তি পেয়ে যায় তাহলে তারা সেগুলো আবার করে। রাষ্ট্রকর্তৃক হোক, রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক হোক বা ব্যক্তি কর্তৃক হোক যে কোনো জায়গা থেকে সাংবাদিকরা যখন শারীরিক নির্যাতন, জীবনের হুমকি বা বিভিন্ন হামলার শিকার হন তখন সেগুলোর যথাযথ বিচার হতে হবে। যখন অপরাধীরা দেখে যে এটা করে পার পেয়ে যাওয়া যায়, কিছুই হয় না তখন তারা আরও বেশি করে। ক্ষমতাশালীরা মনে করে যে আমরা যা কিছু করি না কেন আমাদের কি হবে? আমাদেরকে কে ধরতে পারবে? সমাজে এই ধারণাটা কখন আসে- যখন সত্যিকার অর্থেই তাদের কোনোকিছু হয় না। অর্থাৎ বিচার হয় না, তাদের কোনোভাবে জবাবদিহিতা থাকে না, তখন সেগুলো আবার হতে থাকে। যারা সাংবাদিকদের ওপর হামলার করে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে বিচার হতে হবে। বিচার না হলে সমাজে এগুলো ঠিকই থাকবে।
অধ্যাপক ড. মো. মফিজুর রহমান বলেন, সাংবাদিকদের যদি হুমকি-ধামকি দেয়া হয়, যখন তাদেরকে ফিজিক্যাল থ্রেট দেয়া হবে, মৃত্যুর হুমকি দেয়া হবে, তাদের পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেয়া হবে তখন তাদের মনোবল ভেঙে যাবে। সাংবাদিকতার বড় কাজ হলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। আর সেই অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন করতে গেলে যদি সে হুমকির মুখোমুখি হয় তাহলে তো তার মনোবল ভেঙে যাবে। মনোবল ভেঙে গেলে সে ওই কাজে কেন যাবে? তার জীবন তো আগে। সেটাই যদি হুমকির মুখোমুখি হয় তাহলে যথাযথ সাংবাদিকতা থেকে সাংবাদিকরা বঞ্চিত হবে। এতে করে সাংবাদিকদের সংখ্যা কমে আসবে। কারণ সে ভাববে আমার পরিবার আগে, জীবন আগে।
Cox's Bazar Office: Main Road, Kolatli, Cox's Bazar, Bangladesh.
Ukhia Office: Main Road, Ukhia, Cox's Bazar, Bangladesh.
Email: shimantoshohor@gmail.com
© 2025 Shimantoshohor.com. All rights reserved.