ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী দুঃশাসনের সাড়ে ১৫ বছরে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহাবস্থানের সংস্কৃতি ভুলে কক্সবাজার পরিণত হয়েছিল ভয়ের জনপদে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ দমননীতিতে জেলার মানুষ দেখেছে মধ্যযুগীয় বর্বরতার এক ভয়াবহ অধ্যায়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অধিকাংশ নেতাকর্মী ছিলেন গ্রেপ্তারের ভয়ে পলাতক। কেউ ছিলেন অন্যের বাড়িতে, কেউ রাত কাটাতেন ধানক্ষেতে বা বিলের ধারে। দিন শেষ হতো অস্থিরতায়, রাত কাটতো গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের আতঙ্কে।
গায়েবি মামলা, মিথ্যা মামলা, ব্যবসা ও জমি দখল, চাকরিতে বঞ্চনা—সব মিলিয়ে পর্যটনের রাজধানীখ্যাত কক্সবাজার ছিল দুঃশাসনের দগ্ধচিত্র।
এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠেন টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। মাদকবিরোধী অভিযানের নামে তিনি নিজেই গড়ে তোলেন রক্তের সাম্রাজ্য। শত শত নিরীহ মানুষ তার হাতে ‘ক্রসফায়ার’-এ প্রাণ হারান। কখনো টাকার লোভে, কখনো রাজনৈতিক প্রভাবে, কখনো নারী ও মদের নেশায় প্রদীপ মানুষ হত্যাকে পরিণত করেছিলেন দৈনন্দিন নেশায়। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রকাশ্যে আসে তার নির্মমতার আসল চিত্র। পুলিশের বাইরে প্রদীপ ছিলেন এক দানব, যার কাছে জীবন মানে ছিল কেবল পরিসংখ্যান।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে, আওয়ামী শাসনামলে কক্সবাজার জেলায় ২৬৬ জন ক্রসফায়ারে নিহত হন। জেলা পুলিশের অনীহা সত্ত্বেও স্থানীয় সূত্র বলছে, টেকনাফেই এই সংখ্যা দুই শতাধিক। অন্য উপজেলাগুলোয় আরও বেশ কিছু মানুষকে সাজানো গোলাগুলির নামে হত্যা করা হয়।
রাজনৈতিক দিক থেকেও কক্সবাজারে ছিল ভয়ানক অবস্থা। মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজার-রামু আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, চকরিয়া-পেকুয়ার সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলম, উখিয়া-টেকনাফের প্রভাবশালী আবদুর রহমান বদি, শহরে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র মুজিবুর রহমান, কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি নজিবুর ইসলাম, কক্সবাজার পৌর মেয়র মাহবুবুর রহমান, ছাত্রলীগ নেতা ইশতিয়াক আহমেদ জয়—জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মারুফ প্রত্যেকেই তাদের এলাকায় ছিলেন অপরাজনীতির প্রতীক। তাদের ছত্রছায়ায় চালু হয় দখলবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, ইয়াবা বাণিজ্য, এমনকি খুনোখুনির রাজনীতি।
দলীয় তথ্যমতে, এই সময়ে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে হয় ৯ শতাধিক গায়েবি মামলা, আসামি করা হয় ২৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে। কেবল কক্সবাজারেই জামায়াতের ১৪ ও বিএনপির ৭ জন নেতাকর্মী খুন হন আওয়ামী ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ২০১৩ সালে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের প্রতিবাদে মিছিলে পুলিশের গুলিতে কক্সবাজার শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেদিন প্রাণ হারান জামায়াতের অন্তত পাঁচ কর্মী, আহত হন শত শত মানুষ।
২০১৮ সালে ওসি প্রদীপ টেকনাফে যোগ দেওয়ার পর থেকে পুরো উপকূলীয় জনপদটি হয়ে ওঠে রক্তের রাজ্য। মাদকবিরোধী অভিযানের নামে হত্যাই ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। দুই বছরে মেরিন ড্রাইভে শতাধিক মানুষ ক্রসফায়ারে মারা যান। প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ—‘রক্তের গন্ধ না পেলে তার ঘুম হতো না।’ একরামুল হক হত্যার পর এই নির্মমতার বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে প্রতিবাদ ওঠে।
সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ড ছিল সেই আতঙ্কের শেষ অধ্যায়। এই ঘটনার পরই প্রদীপ ও সহযোগীরা গ্রেপ্তার হন, ক্রসফায়ারের রাজনীতি থেমে যায়। ধীরে ধীরে এলাকায় ফেরেন পলাতক বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীরা।
দলীয় নেতারা জানান, আওয়ামী দুঃশাসনে কক্সবাজারে বিএনপির বিরুদ্ধে অন্তত ৫০০ গায়েবি মামলা হয়, আসামি হয় প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মী। জামায়াতের ওপরও নেমে আসে একই নিপীড়ন। তাদের দাবি, ৪০০ গায়েবি মামলায় ১৫ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হয়। সরকার পরিবর্তনের পর এইসব মামলার অনেকগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ সময় গুমের ঘটনাও ছিল আলোচিত। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে ২০১৫ সালে ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ দুই মাস পর ভারতের মেঘালয়ে তাকে পাওয়া যায়। নয় বছর নির্বাসনের পর তিনি দেশে ফেরেন ২০২৪ সালের আগস্টে। একইভাবে টেকনাফের আওয়ামী নেতা মোস্তাক আহমদও ২০১৫ সালে গুম হন—ফিরে আসেননি আর।
কক্সবাজার জেলা জামায়াতের আটজন শীর্ষ নেতাকে ক্রসফায়ারে হত্যার পরিকল্পনার অভিযোগও ওঠে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জেলা নায়েবে আমির অ্যাডভোকেট শাহজালাল চৌধুরী, সাবেক টেকনাফ পৌর মেয়র মোহাম্মদ ইসমাঈল, ছাত্রনেতা শহিদুল আলম বাহাদুর ও সরওয়ার আলম সিকদার। কেউ কেউ অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।
উখিয়ার শাহজালাল চৌধুরীর ঘটনা ছিল বিশেষভাবে আলোচিত। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থীর পক্ষে ভোট না পড়ায় তাকে হত্যা করার নির্দেশ আসে বলে পরিবারের দাবি। সেদিন রাতে কয়েকটি বাহিনীর ১৩টি গাড়ি তার বাড়ি ঘিরে ফেলে, কিন্তু তিনি অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান।
এই সময় কক্সবাজারে দখলবাজি ছিল নিত্যদিনের চিত্র। সৈকতের বালিয়াড়ি, সরকারি জমি, মার্কেট, চিংড়িঘের—সবকিছুতেই আওয়ামী প্রভাবশালীদের দখল। সমুদ্র সৈকতের ‘ড্রাগন মার্কেট’ এখনো দখলদারির সাক্ষ্য বহন করছে। এখানকার দখলবাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবুর রহমান, মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, নজিবুর ইসলাম, ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম, মারুফ ও সাইমুম সরওয়ার কমলের বোন নাজনিন সরওয়ার কাবেরী।
পেকুয়া ও চকরিয়ায় প্রভাব বিস্তার করেছিলেন জাফর আলম, টেকনাফ ও উখিয়ায় আবদুর রহমান বদি, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন আশেক উল্লাহ রফিক ও মকছুদ মিয়া। রামু নিয়ন্ত্রন করতেন সাইমুম সরওয়ার কমল। পাহাড়, নদী, ঘের, বালুমহাল—সবকিছুর দখলেই তাদের প্রভাব ছিল।
শেখ হাসিনার পতনের আগে জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে কক্সবাজার থেকেও পাঁচ তরুণ শহীদ হন। কক্সবাজার শহরে একজন, ঈদগাঁওয়ে একজন এবং তিনজন চট্টগ্রামে প্রাণ হারান।
বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, “আমাদের নেতাকর্মীরা নিজেদের বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি। শত শত গায়েবি মামলা, মিছিল-মিটিংয়ের নিষেধাজ্ঞা, সর্বত্র ভয়—এই ছিল আওয়ামী দুঃশাসনের কক্সবাজার।”
জামায়াতের জেলা সেক্রেটারি জাহেদুল ইসলাম বলেন, “আমাদের ব্যবসা, অফিস, প্রতিষ্ঠান দখল করা হয়েছে। তিন শতাধিক গায়েবি মামলা হয়েছে। তবু আমরা সংগঠন টিকিয়ে রেখেছি।”
দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ধরে কক্সবাজার ছিল এক রক্তাক্ত অধ্যায়—যেখানে বিচার, মানবাধিকার আর স্বাধীন মতপ্রকাশের জায়গা ছিল না। মানুষ বেঁচে ছিল আতঙ্কে, প্রশাসন ছিল দুঃশাসনের অংশীদার, আর রাজনীতি ছিল প্রতিহিংসার হাতিয়ার।
Cox's Bazar Office: Main Road, Kolatli, Cox's Bazar, Bangladesh.
Ukhia Office: Main Road, Ukhia, Cox's Bazar, Bangladesh.
Email: shimantoshohor@gmail.com
© 2025 Shimantoshohor.com. All rights reserved.