আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ব্যাপক লুটপাতের খেসারত দিতে হচ্ছে। এতে সংকটের সম্মুখীন হয়েছে পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংকের গ্রাহকরা। গ্রাহকরা তাদের জমানো টাকা তুলতে না পেরে চরম বিপাকে পড়েছেন।
ব্যাংকগুলো হলো: এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক সহায়তা দিয়ে কিছু সময়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও সেই প্রক্রিয়া এখন স্থগিত রয়েছে। অনেকে ব্যাংকে গিয়ে হয়রান হয়ে কান্নাকাটি করে ফেরত আসছেন। অনেকে গচ্ছিত টাকা ফেরত না পেয়ে ধারদেনা করে আর্থিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন।
ইউনিয়ন ব্যাংকের হাটখোলা শাখায় সরেজমিন দেখা যায়, গ্রাহকদের হতাশাময় চিত্র। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মনমরা হয়ে বসে আছেন। শাখা ব্যবস্থাপকের অনুপস্থিতিতে এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা বন্ধ রাখায় গত এক মাস ধরে কাউকে কোনো টাকা ফেরত দিতে পারিনি।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় দেখা যায় একই চিত্র। কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা বন্ধ হওয়ার পর আমরা একদম ফেঁসে গেছি। শুরুতে কিছু টাকা ফেরত দিতে পারলেও বর্তমানে পিঠ একদম দেয়ালে ঠেকে গেছে। একজন গ্রাহক টাকা না পেয়ে যে ভাষায় গালাগাল করেছেন, তা সহ্য করার মতো নয়।
আ.লীগ আমলের লুটপাটের খেসারত দিচ্ছেন ৫ ব্যাংকের গ্রাহকরা
স্কুল শিক্ষক আবদুল কাদের ও সাদ্দাম হোসেনের মতো বহু গ্রাহক তাদের জমানো টাকা তুলতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আবদুল কাদের ১৮ বার ব্যাংকে গিয়ে এক টাকাও পাননি।
এই চিত্র শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশজুড়ে। গ্রাহকদের অভিযোগ, দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও টাকা পাচ্ছেন না; বরং প্রতিনিয়ত তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে নানা অজুহাতে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ নেয়। দুর্বল ব্যাংকগুলোর ১৪টি পর্ষদ বিলুপ্ত করা হয় এবং প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু এই পদক্ষেপও বড় অঙ্কের সঞ্চয় ফেরত পাওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়নি।
টাকা ফেরত না পাওয়া ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মতো বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের কয়েক লাখ গ্রাহকের প্রতিদিনের বাস্তবতা এমন। গত বছর ৫ আগস্টের পর এসব ব্যাংকে আমানত তোলার হিড়িক পড়েছিল। সেই চাপ এখনো সামলে উঠতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
ব্যাংক খাত বিশ্লেষকদের মতে, কিছু ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও মার্জার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, তারা ধাপে ধাপে সমস্যাগুলো সমাধান করছে। তবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আরও সময় লাগবে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন জানান, গত জুলাই ও চলতি আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো সহায়তা পাননি। সে কারণে সংকট বেশি দেখা যাচ্ছে। মার্জার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় সংকট কিছুটা কমবে বলে আশা তার।
বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, মুখের কথায় বা অযৌক্তিক আবদারে মার্জার ঠেকানো যাবে না। ক্যামেলস রেটিং, খেলাপি আদায়, এডিআর, ধার পরিশোধসহ যারা ব্যাংকের বিভিন্ন আর্থিক সূচকে দৃশ্যমান উন্নতি ঘটাতে পারবে না, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত করা হবে। ধার করে টিকে থাকা এবং আগের ধারও পরিশোধে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোকে আর কোনো তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। শুধু এই পাঁচ ব্যাংক নয়, আরও ডজনখানেক ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। পদ্মা ব্যাংকসহ রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ও অসুস্থ রাজনীতির শিকার একাধিক ব্যাংকের লাখ লাখ গ্রাহক এখন প্রায় নিঃস্ব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্জ হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানত ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা এবং বিতরণকৃত ঋণ ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা খেলাপি। যা বিতরণ করা ঋণের ৭৭ শতাংশ। মূলধনে ঘাটতি ৪৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা, গ্রাহক সংখ্যা ৯২ লাখ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৫ হাজারের বেশি।
সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য এই সংকটকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। তিনি বলেছেন, ‘ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যা পুনর্গঠনের জন্য ৩৫ বিলিয়ন ডলার লাগবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।’ এই পরিস্থিতিতে ‘ব্যাংকে জমা রাখা টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই’ বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বার্তা গ্রাহকদের কাছে রীতিমতো হাস্যরস ছাড়া আর কিছুই নয়। ৩০ আগস্ট দৈনিক যুগান্তরে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।