চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেফতার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবদুর রাজ্জাক রিয়াদের গ্রামের বাড়িতে যেন আলাদীনের চেরাগ মিলেছে। রিকশাচালক বাবার অভাব-অনটনের সংসারে বড় হলেও গত এক বছরে বাড়িতে উঠেছে পাকা দালান। পড়ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্যবহার করেন দামি মোটরসাইকেল।
সোমবার (২৮ জুলাই) তার নোয়াখালীর সেনবাগের নবীপুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে পাকা ভবন তৈরির কাজ চলছে। প্রায় আড়াই মাস আগে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়ে গত সপ্তাহে দেওয়া হয়েছে ছাদ ঢালাই।
আবদুর রাজ্জাক রিয়াদ নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার নবীপুর গ্রামের হতদরিদ্র আবু রায়হানের ছেলে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট রিয়াদ। বড় ভাই চট্টগ্রামে একটি ফিশারিজ কোম্পানিতে চাকরি করেন। আর রিয়াদ বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
রিয়াদের গ্রামের প্রতিবেশীরা বলেন, আর্থিক অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা একজন ছাত্রের বাড়িতে হঠাৎ পাকা ভবন নির্মাণ নিয়ে এলাকায় নানা আলোচনা চলছে। এ আলোচনায় নতুন মাত্রা পেয়েছে চাঁদাবাজির অভিযোগে রিয়াদের গ্রেফতারের ঘটনা। তবে জমানো টাকা, অনুদান ও ঋণ নিয়ে ভবনটি করা হচ্ছে বলে দাবি তার পরিবারের।
রিয়াদের চাচা মো. জসিম উদ্দিন জানান, দুই-আড়াই মাস আগে রিয়াদ ভবন নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছেন। আগে ভাঙাচোরা একটি টিনের ঘর ছিল। ওই ঘরের জায়গায় নতুন ভবন করা হচ্ছে। রিয়াদের মা-বাবা এখন বাড়ির প্রবেশপথের পাশের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রিয়াদের বাড়ির এক নারী বলেন, রিয়াদের বাবা ও বড় ভাই দুজনই রিকশা চালাতেন। এখন চালান না। রিয়াদ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে বলে শুনেছেন। গত ৫ আগস্টের পর সমন্বয়ক হয়েছে। কিছুদিন পরপর বাড়িতে আসে। দুই-আড়াই মাস আগে পুরোনো ঘর ভেঙে পাকা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।
বাবা আবু রায়হান বলেন, ৫০ বছর পর ছেলের ইজ্জতের কথা চিন্তা করে ৫৬ হাজার টাকার গরু দিয়ে কোরবানি দিয়েছি। আগে মানুষের দানে ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করাইছি। এখন সে টিউশনি করে রোজগার করে। আমাকে ঘরের কাজেও কিছু সহযোগিতা করেছে। বাকিটা জমানো ও ঋণের টাকায় কাজ করছি।
রিয়াদের মা রেজিয়া বেগম বলেন, আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছোট ছেলে রিয়াদ ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বড় ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। তবে বড় ছেলে ফুটপাতে ব্যবসা করেন বলেও জানান রিজিয়া বেগম। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বলে জানান।
রেজিয়া বেগম আরও বলেন, মানুষের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছি। ছেলে নিজেও টিউশনি করে, পড়ালেখার খরচ জোগাড় করে। পাকা ভবন নির্মাণে ব্র্যাক থেকে ঋণ, স্বামীর জমানো টাকাসহ ধারদেনাও করেছি।
গত বছরের বন্যায় ঘর সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল উল্লেখ করে রেজিয়া বেগম বলেন, বন্যার পর সরকারের কাছ থেকে চার বান্ডিল ঢেউটিন পেয়েছি, সেগুলো বিক্রি করেছি। আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। এসব টাকাও ঘরের কাজে ব্যয় করা হয়েছে। তবে ব্র্যাক থেকে ঋণ নেওয়ার কাগজপত্র দেখাতে পারেননি রেজিয়া বেগম।
তবে এলাকাবাসীর ভাষ্য, রাজ্জাকের টাকায় পাকা ভবন হচ্ছে। ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর থেকে রিয়াদের পরিবর্তন লক্ষ্য করেন এলাকাবাসী। বাড়িতে এলে দাপটের সঙ্গে কথা বলতেন। কিন্তু তিনি আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছিলেন কাদের মির্জাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠ।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. জুনায়েদ হোসেন বলেন, রিয়াদ এমনিতে ভদ্র ছেলে। তবে ৫ আগস্টের পর জানতে পারি সে সমন্বয়ক হয়েছে। বছর না ঘুরতেই বাড়িতে পাকা ভবন নির্মাণ করছে। এসব নিয়ে এলাকার মানুষজনের আলোচনা রয়েছে। চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার হওয়ায় সেই আলোচনা অনেকগুণ বেড়েছে।
আরেক প্রতিবেশী সোলায়মান বলেন, রিয়াদ এখন কোটি টাকার মালিক। বাড়িতে পাকা ভবন করছে। দামি বাইক কিনেছে। আরও নানা কথা শোনা যায়।
রবিউল ইসলাম নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, একজন ছাত্র কী করে এত টাকার মালিক হয়, ভেবে কূল পাই না! এখন আবার চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেফতার হলো। আমরা এসবের নিন্দা জানাই।
নবীপুর হাইস্কুলের সাবেক সভাপতি শিহাব উদ্দিন বলেন, আমার স্কুলের এই ছাত্রকে সবাই দান-খয়রাত করে পড়াত, কারণ তার দরিদ্র রিকশাচালক বাবার পক্ষে পড়ালেখার খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। সে কীভাবে এত ভয়ংকর চাঁদাবাজ হয়ে উঠলো তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
রিয়াদের নির্মাণ করা ভবনের আয়তন ৯০০ থেকে এক হাজার বর্গফুট হতে পারে। এমন আয়তনের একটি ভবন করতে কত টাকা খরচ হতে পারে, তা জানতে চাওয়া হয় একজন প্রকৌশলীর কাছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই প্রকৌশলী বলেন, এক হাজার বর্গফুটের একটি পাকা ভবন নির্মাণ করতে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা লাগার কথা। এখন পর্যন্ত যে কাজ (ছাদ ঢালাই) করা হয়েছে, তাতে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা।
রিয়াদের সহপাঠী কোরবান আলী হৃদয় বলেন, আমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রিয়াদের সঙ্গে পড়েছি। পরে এইচএসসি পাস করে সে ঢাকায় ভর্তি হয়েছে। শুনেছি, সেখানে রাজনীতি করত এবং পরে গত ৫ আগস্টের পর সমন্বয়ক হয়েছে। এখন গ্রেফতার হওয়ায় এলাকায় তাকে নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
গত শনিবার (২৬ জুলাই) সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানে সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় চার সহযোগীসহ গ্রেফতার হন আবদুর রাজ্জাক রিয়াদ। এ ঘটনায় গুলশান থানায় করা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিয়াদসহ চারজনকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।
ফেসবুকে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে নিজের শক্তির জানান দিতেন রিয়াদ। তার ছবির ফ্রেমে বাদ যাননি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও। একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে ছবি পাওয়া গেছে তার ফেসবুকে।
Cox's Bazar Office: Main Road, Kolatli, Cox's Bazar, Bangladesh.
Ukhia Office: Main Road, Ukhia, Cox's Bazar, Bangladesh.
Email: shimantoshohor@gmail.com
© 2025 Shimantoshohor.com. All rights reserved.