কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে রাতারাতি দোকানঘর গড়ে ওঠায় আবারও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যেখানে এসব স্থাপনার অনুমতি দিয়েছে জেলা প্রশাসন সেখানে আবার সেই প্রশাসনই কেন উচ্ছেদে নামছে?
শুক্রবার রাত থেকে রোববার ভোর পর্যন্ত সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে একই রকম নকশায় সারি সারি দোকান বসানো হয়। নির্মাণকারীদের দাবি, তারা প্রশাসনের দেওয়া অনুমতিপত্র হাতে নিয়ে দোকান বসাচ্ছেন।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সমালোচনার মুখে রবিবার দুপুরে এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন।
সাংঘর্ষিক অবস্থান
সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আজিম খান বলেন, “নতুন দোকান বসানো হয়েছে, সত্যতা পেয়েছি। এগুলো সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
কিন্তু একইসঙ্গে তিনি স্বীকার করেন নির্মাণকারীদের কাছে প্রশাসনের অনুমতিপত্র রয়েছে।
“সে অনুমতিতে শর্ত আছে প্রয়োজনে প্রশাসন তা বাতিল করতে পারবে” বলেন মো. আজিম খান।
অর্থাৎ, অনুমতি দিয়ে আবার উচ্ছেদে নামার ঘটনা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
সৈকতে দোকান বসানো এক ব্যক্তি বলেন, “গত বছরের ৫ আগস্টের আগেও এখানে অনেকে ব্যবসা করেছে। আমরা করলে সমস্যা কোথায়?”
আরেকজন দাবি করলেন, “আমরা ঝিনুকের ব্যবসা করি। পর্যটকরা এ দোকান থেকে কিনে নিয়ে যায়। এতে কারও ক্ষতি হয় না।”
অভিযোগ: গোপনে অনুমতি বিতরণ
গত এক বছরে জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেল থেকে প্রায় ৩০০ দোকান বরাদ্দের অনুমতি দেওয়া হয়। রাজনৈতিক প্রভাবশালী থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপ সামলাতেই এই অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহেদুল আলম স্বীকার করেন, “আমরা বিব্রত। একদিকে অনুমতি দেওয়া, আবার রাতারাতি দখল হয়ে যাওয়া এটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি।”
অনুমতি পত্র হাতে ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন করেন, “যদি অনুমতি বৈধ হয়, তবে স্থাপনাগুলো অবৈধ কেন? আর যদি অবৈধ হয়, তবে সেই অনুমতি কীভাবে দেওয়া হলো?”
আদালতের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সাংঘর্ষিক
হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ‘পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)’, সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ বা ব্যবসা বসানো যাবে না।
কক্সবাজারের পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সৈকতের বালিয়াড়ি দখলের জন্য প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে, এটাই মূল সাংঘর্ষিক বিষয়।
জেলা বাপার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, “এমন সাংঘর্ষিক পদক্ষেপে আসলে কারা দায়ী? আর আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যে অনুমতি দেওয়া হলো, তার জবাবদিহি করবে কে?”
পরিবেশবাদী এডভোকেট মুজিবুল হক বলেন, “যেখানে সৈকতকে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা আছে, সেখানে অনুমতি দেওয়া আদালতের আদেশ অমান্য করার সামিল।”
সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা মনে করেন, “বালিয়াড়ি প্রাকৃতিকভাবে উপকূল রক্ষার প্রাচীর। এগুলো দখল হলে পরিবেশের পাশাপাশি পর্যটন শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
এদিকে কক্সবাজার সৈকতে বালিয়াড়ি দখল করে স্থাপনা নির্মাণকারীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন জানান, “সুগন্ধা, লাবণী ও কলাতলীতে অন্তত দুইশত অবৈধ স্থাপনার তালিকা আমরা তৈরি করছি।”
ট্যুরিস্ট পুলিশের নাটকীয়তা
সৈকতের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে রয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার জোনের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, “আমাদের দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা। কিন্তু রাতের আঁধারে সৈকত দখল করা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে অবৈধ স্থাপনা সরাতে কাজ করব।”
অথচ সৈকতের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, গত তিনদিন ধরে রাতের আঁধারে এসব স্থাপনা উঠছে, কোনো বাধা ছাড়াই।
এর আগে একাধিকবার সৈকতে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও কিছুদিনের মধ্যে ফের দোকান বসে গেছে। এবারও সেই পুরনো চিত্রই ফিরে এসেছে, তবে নতুন মাত্রা যোগ করেছে প্রশাসনের অনুমতি।
বাপার জেলা সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই দখল ঠেকাতে যদি কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত হারাতে পারে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আর কক্সবাজার পর্যটনের প্রাণও পড়তে পারে বড় ঝুঁকিতে।
Cox's Bazar Office: Main Road, Kolatli, Cox's Bazar, Bangladesh.
Ukhia Office: Main Road, Ukhia, Cox's Bazar, Bangladesh.
Email: shimantoshohor@gmail.com
© 2025 Shimantoshohor.com. All rights reserved.