
চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে আবারও অস্থিরতা ও হত্যার রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়েছে। চেনা পাহাড়ে সশস্ত্র পাহাড়িদের হাতে নিরীহ পাহাড়ি ও বাঙ্গালী হত্যার নেপথ্যে উঠে এসেছে একটি পরিচিত নাম — মাইকেল চাকমা। যিনি ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)–এর মুখপাত্র। নির্বিচারে হত্যা, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র ব্যবসাসহ স্পর্শকাতর একাধিক মামলার আসামি হয়েও তিনি এখন পার্বত্য রাজনীতিতে প্রভাবশালী নাম। ফলে তার বিরুদ্ধে পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে।
দেশের একাধিক গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সূত্র বলছে, সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে কথিত ধর্ষণ নাটক সাজিয়ে অস্থিরতা তৈরির পেছনেও মাইকেল চাকমার ঘৃণ্য পরিকল্পনা ছিল। যদিও সূত্র বলছে, ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সংগঠনটি পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে আসছে। ফলে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তির সময় তারা চুক্তির বিরোধীতা করে এবং “পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন” স্লোগান তুলে পাহাড়ে সশস্ত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
যার ফলে দীর্ঘ ২৮ বছর পরও পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির বদলে রক্তপাত এবং সার্বভৌমত্বের ঝুঁকি ক্রমশ বেড়েই চলছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, ইউপিডিএফের হাতে এখনো রয়ে গিয়েছে পার্বত্য শান্তি চুক্তির আওতায় জমা না দেওয়া বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র। শুধু তাই নয়, এতে যুক্ত হচ্ছে নতুন ও আধুনিক ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ। যেটি পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশের মুল করিডোর ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরার পাশাপাশি মিয়ানমারের সীমান্ত পথগুলো। যার আর্থিক যোগান আসে “চাঁদাবাজি ও মাদক লেনদেনের” মাধ্যমে।
পার্বত্য রাজনীতির দুই নেতা — শক্তিমান চাকমা ও মাইকেল চাকমা — একসময় ছিলেন একই সংগঠনের নিবেদিত কর্মী। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সংগঠন নিয়ন্ত্রণের লড়াই থেকে তাদের আভ্যন্তরে জন্ম নেয় ভয়ংকর সংঘাত। ইতিপূর্বে ২০১১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শৃঙ্খলা বাহিনী র্যাব, অস্ত্রসহ মাইকেল চাকমাকে গ্রেফতার করলে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়। এ সময় শক্তিমান চাকমা ক্রমশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে নানিয়ারচর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। মুলত এই পরিবর্তনই মাইকেল চাকমার মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বালায়।
ফলে ২০১৮ সালের ৩ মে, অফিসে যাওয়ার পথে শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই সাথে এর পরদিন, শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়া তপন জ্যোতি (বর্মা) ও তাঁর সঙ্গীদের গাড়িবহরেও সশস্ত্র হামলা হয়। এতে তপন জ্যোতিসহ তিনজন নিহত হন। এই দুটি সফল হত্যাকাণ্ডের পর, ঘটনার পরিকল্পনার নেপথ্যে পুনরায় মাইকেল চাকমার নাম উঠে আসে। যা পরবর্তীতে মামলা আকারে নানিয়ারচর থানায় রেকর্ড করা হয়।
মাইকেল চাকমা ২০১৯ সালে “গুম” হন বলে তার পরিবার দাবি করে। তবে সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মতবিরোধের জেরেই, তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করেছিল। অতঃপর ২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর, তিনি পুনরায় প্রকাশ্যে আসেন এবং ইউপিডিএফের নেতৃত্বে সক্রিয় হন। প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই মাইকেল নিজেকে “ভিকটিম” হিসেবে উপস্থাপন করার পাশাপাশি, পাহাড়ে নতুন করে বিভাজন সৃষ্টি করছেন এমন একাধিক অভিযোগ ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে উঠেছে।
পার্বত্যাঞ্চলে চাঁদাবাজির অর্থই ইউপিডিএফের অস্ত্রের মূল জোগান বলে অভিযোগ করেছে নিরাপত্তা সূত্র। সূত্রটি আরো জানায়, এই অর্থ দিয়েই সংগঠনটি বিভিন্ন সীমান্তপথে আধুনিক অস্ত্র কিনে এনে পাহাড়ে মজুদ করছে। শুধু তাই নয়, অস্ত্রের মজুদ বাড়াতে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিয়মিত “চাঁদা” আদায় এখন ওপেন সিক্রেট বিষয়। চিরকুট প্রদান, বিভিন্ন আলামত রেখে আসা সহ বিভিন্ন কায়দায় চলছে ইউপিডিএফের চাঁদাবাজি। যা থেকে নিস্তার মিলছে না ব্যবসায়ী, স্থানীয় অধিবাসী থেকে শুরু করে পর্যটকদের কারোই।
এখনো পর্যন্ত অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁর নামে ১১টি নিশ্চিত মামলা রয়েছে (স্থানীয় সূত্র মতে সংখ্যা ২০টির বেশি)। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য মামলার তথ্য নিচে দেওয়া হলো:
| সাল | এলাকা ও থানার নাম | অভিযোগ | মামলার অবস্থা |
|---|---|---|---|
| ২০০৭ | লংগদু, রাঙামাটি | জেলেদের মারধর ও চাঁদাবাজি (মামলা নং ০৪) | অস্ত্রসহ গ্রেফতার |
| ২০০৭ | ভাইবোনছড়া, রাঙামাটি | খুন ও অস্ত্র চোরাচালান | সেনা অভিযান পরিচালিত |
| ২০১১ | জুরাছড়ি | নিরঞ্জন চাকমা হত্যা (মামলা নং ১) | মূল আসামি |
| ২০১১ | সিএমপি, পাহাড়তলী | ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগ | গ্রেফতার |
| ২০১৮ | নানিয়ারচর | শক্তিমান চাকমা হত্যা | আসামি নং ৩৭ |
| ২০১৮ | নানিয়ারচর | তপন জ্যোতি (বর্মা) হত্যা | আসামি নং ৩১ |
| ২০১৮ | বাঘাইছড়ি | সুরেন বিকাশ চাকমা হত্যা | আসামি নং ৪ |
| ২০১৮ | বাঘাইছড়ি | বন কুসুম চাকমা হত্যা | আসামি নং ৪ |
| ২০১৮ | বাঘাইছড়ি | মিশন চাকমা হত্যা | আসামি নং ৩ |
বিশ্লেষকরা বলছেন —পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর তিন দশকেও যদি পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ হত্যার চক্র বন্ধ না হয়, তাহলে এই অস্থিরতা শুধু পাহাড়েই নয়, দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
পাশাপাশি মাইকেল চাকমার মতো বিতর্কিত ব্যক্তিরা, যারা একদিকে গুমের শিকার দাবি করেন, আবার অন্যদিকে সংগঠিত সহিংসতায় জড়িত থাকেন, তাদেরকে বিচারের আওতায় না আনা গেলে পার্বত্য অঞ্চলে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।
Cox's Bazar Office: Main Road, Kolatli, Cox's Bazar, Bangladesh.
Ukhia Office: Main Road, Ukhia, Cox's Bazar, Bangladesh.
Email: shimantoshohor@gmail.com
© 2025 Shimantoshohor.com. All rights reserved.