শীত মৌসুম শুরু না হতেই কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত এলাকায় ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র। মালয়েশিয়ায় উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষদের পাচারের চেষ্টা করছে চক্রটি। পাচারকারীরা টেকনাফের দুর্গম পাহাড়ি আস্তানায় ভুক্তভোগীদের আটকে রেখে আদায় করছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানায়, সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে ১১ জন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার ও মানবপাচার চক্রের ১২ সদস্যকে আটক করা হয়েছে। এসব অভিযানে উঠে এসেছে ভয়াবহ ও চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
বিজিবির তথ্যমতে, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ায় ছড়িয়ে থাকা এই আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় পরিচালিত হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত পাচারকারীরা স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে লোক সংগ্রহ, আটকে রাখা এবং মুক্তিপণ আদায়ের মতো কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
প্রলোভন দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের বলা হয়, মালয়েশিয়ায় গেলে পাওয়া যাবে উচ্চ বেতনের চাকরি, সহজ বিদেশযাত্রার সুযোগ এবং পরবর্তীতে আয় করে খরচ পরিশোধের সুযোগ। এরপর তাদের মিয়ানমারে পাঠিয়ে আটক রেখে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় মুক্তিপণ।
গত রোববার সাগরপথে ১০০ জন মিয়ানমার নাগরিক পাচারের সময় অভিযান চালিয়ে তা প্রতিহত করে বিজিবি। আটক করা হয় চক্রের ৪ সদস্যকে। মঙ্গলবার রাতে মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন কচ্ছপিয়া ও বড়ইতলি এলাকা থেকে আরও ৮ পাচারকারীকে আটক করা হয় এবং উদ্ধার করা হয় ১১ জন ভুক্তভোগীকে।
আটক ব্যক্তিরা হলেন : মোঃ আব্দুর রশিদ (৩৫), মোঃ মিজানুর রহমান (২০), মোঃ আবু তৈয়ব (২৫), মোঃ ইদ্রিস (৩৫), জাহেদ (১৮), মোঃ জুবায়ের (৩৩), নুরুল আবছার (১৮), মোঃ ইসমাইল (৩২), মোঃ ইমরান (২৮), নুর মোহাম্মদ (৪০), মাহমুদউল্লাহ (৩০) ও খুরশিদা বেগম (৩৪)। আটক ব্যক্তিরা উখিয়া, টেকনাফ ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা।
উদ্ধার হওয়া সালামত উল্লাহ বলেন, ‘মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে পাহাড়ি এলাকায় এনে বন্দি করে রাখে। আমাদের একটি রুমে তালাবদ্ধ করে দুই দিন খাবার দেয়নি। পরে বলেছে, মালয়েশিয়ায় পৌঁছালে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিতে হবে।’
বিজিবির অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে অবস্থানরত হোসেন, সাইফুল ও নিজাম নামের তিন ব্যক্তি এই আন্তর্জাতিক চক্রের মূলহোতা। তাদের অধীনে রয়েছে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত দালাল ও দস্যুদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। চক্রটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী, মাদক পাচারকারী এবং বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের সঙ্গে যোগসাজশে কাজ করছে।
টেকনাফস্থ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে বিজিবি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে। জুলাই মাসে ১৫ জন, আগস্টে ৪ জন এবং সেপ্টেম্বর মাসে (এ পর্যন্ত) ১৭ জন পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ-এই তিন দেশে বিস্তৃত এই চক্রকে দমন করতে সব বাহিনীর সমন্বয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মানবপাচারের মতো জঘন্য অপরাধ থেকে নিজেকে ও সমাজকে রক্ষায় সতর্ক থাকুন। বিদেশ যাওয়ার আগে তথ্য যাচাই করুন এবং সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার আহ্বান জানান ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান।
চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত এলাকা থেকে মোট ৬২ জন মানবপাচারকারীকে আটক করেছে বিজিবি। ২৪ জন আসামি এখনও পলাতক রয়েছে। তবে, চক্রের মূল হোতা এবং বাকি সদস্যদের ধরতে ভবিষ্যতে আরও অভিযান চলছে বলেও জানায় বিজিবি।