তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি ‘সমন্বিত প্রস্তাব’ দিয়েছে। এতে একটি সংসদীয় বাছাই কমিটির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবটি আরও পর্যালোচনা করে দলগুলোকে মতামত দিতে বলা হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে পারে ঐকমত্য কমিশন।
আজ রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐক্যমত কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় ধাপের ১৫ তম দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আলী রীয়াজ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এর আগেও কয়েক দফা আলোচনা হয়েছিল। তখন এর রূপরেখা নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের কাছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি আলাদা আলাদা প্রস্তাব জমা দিয়েছিল। প্রস্তাবগুলোকে মিলিয়ে আজ একটি সমন্বিত প্রস্তাব হাজির করে ঐকমত্য কমিশন। সমন্বিত প্রস্তাবটি নিয়ে দলগুলো মোটামুটি একমত হলেও কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়। পরে একটি সংশোধিত সমন্বিত রূপরেখা উপস্থাপন করে কমিশন। দলগুলোকে প্রস্তাবটি লিখিত আকারে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য থাকলে তা আগামীকাল সোমবার কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে।
সমন্বিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়া বা অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে এবং মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার বয়সসীমা হবে সর্বোচ্চ ৭৫ বছর।
সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ৩০ দিন আগে জাতীয় সংসদের স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) ও সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধি—মোট পাঁচ সদস্যের ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে। কমিটির যেকোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার।
কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্য ব্যক্তির নাম চাইবে। একটি দল ও একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কেবল একজন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবেন। রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ে তাঁদের প্রস্তাবিত নাম জমা করবেন।
# বাছাই কমিটি হবে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে। # কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন।
এরপর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কমিটির সদস্যরা সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত এবং রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া নামগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন। ওই ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
বাছাই কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ১২০ ঘণ্টার মধ্যে এই পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে চূড়ান্ত করা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য সংসদের সরকারি দল বা জোট তিনজন, প্রধান বিরোধী দল বা জোট তিনজন এবং সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দল দুজন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে। নামগুলো স্পিকার জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করবেন।
এরপর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি দল বা জোটের প্রস্তাবিত তালিকা থেকে প্রধান বিরোধী দল বা জোট যেকোনো একজনকে বেছে নেবে। একইভাবে প্রধান বিরোধী দল প্রস্তাবিত তালিকা থেকে সরকারি দল যেকোনো একজনকে বেছে নেবে। তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রস্তাবিত তালিকা থেকে সরকারি দল বা জোট একজনকে এবং প্রধান বিরোধী দল বা জোট যেকোনো একজনকে বেছে নেবে। একইভাবে তৃতীয় বৃহত্তম দল সরকারি দল এবং বিরোধী দলের তালিকা থেকে একজন করে বেছে নেবে। এভাবে পাওয়া নামগুলোর মধ্য থেকে যেকোনো একজনের ব্যাপারে যদি প্রস্তাবকারী দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়, তবে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত হবেন।
এ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত না হলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে বাছাই কমিটির সদস্যরা গোপন ব্যালটে ‘র্যাঙ্কড চয়েজ’ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে ওই সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে একজনকে বেছে নেবেন।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য পূর্ববর্তী র্যাঙ্কড চয়েজ/ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেবেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানালে বা দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে পরবর্তীজনকে নিয়োগ দেবেন।
প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি বাছাই কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ১৫ জনকে উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন।
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিলুপ্ত সংসদের একই ধরনের প্রতিনিধিদের নিয়ে বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে অভিন্ন পদ্ধতিতে একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বাছাই করবে।
আজকের আলোচনা শেষে বিকেলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, এ প্রস্তাবের অধিকাংশ বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। খসড়া প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা করে দলগুলো আগামীকাল সোমবার কমিশনকে মতামত জানাবে। কমিশন আশা করছে, আগামী মঙ্গলবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ প্রণয়নের লক্ষ্যে গত ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ করছে বলে জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘আজ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইতিমধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। আশা করছি, বাকি দিনগুলোর সংলাপে আরও কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং জুলাই মাসের মধ্যেই একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা সম্ভব হবে।’