ভালোবাসা, যত্ন আর সুযোগ পেলে পরিবারহীন শিশুরাও ঘুরে দাঁড়াতে পারে—তা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করেছে পঞ্চগড়ের আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর ১২ শিক্ষার্থী। পরিবার হারিয়ে ফেলা বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এই কিশোররা এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছে। তাদের এই অর্জনে খুশিতে কেঁপে উঠেছে পুরো শিশু নগরী। চোখে এখন নতুন জীবনের স্বপ্ন।
এসব কিশোরদের কেউ পথশিশু, কেউ হারিয়ে যাওয়া, কেউ অবহেলায় পরিবারত্যাগী। সকলেই বেড়ে উঠেছে পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে অবস্থিত ‘আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী’তে। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কেন্দ্রটি অনাথ, ছিন্নমূল, পথশিশু ও বঞ্চিত শিশুদের আশ্রয় দিয়ে থাকে।
এই বছর পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় তারা। ১২ জনই পাস করেছে, অনেকেই অসাধারণ ফলাফল করেছে।
সবার জীবনের গল্পই আলাদা, কিন্তু যন্ত্রণার ছাপ এক। কবির হোসেন হৃদয় পেয়েছেন জিপিএ-৪.৯৬। ৫ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়েন। পরে এক রেলস্টেশন থেকে উদ্ধার হয়ে শিশু নগরীতে আশ্রয় পান। এখন তার স্বপ্ন, বাবা-মায়ের কাছে ফিরবেন একদিন। আব্দুল মজিদ পেয়েছেন জিপিএ-৪.৮২। ছোটবেলায় হারিয়ে যান। পরে পরিবারকে খুঁজে পেলেও থেকে যান শিশু নগরীতেই। বলেন, “এটাই আমার বড় ঠিকানা। সব্বির হোসেন (জিপিএ-৪.৭৫) জানেন না তার বাড়ি কোথায়। মনে আছে কেবল মা-বাবার নাম। তিনি বলেন, “এই শিশুনগরীই আমাদের ঘর। রফিকুল ইসলাম (জিপিএ-৪.৫০) ও পারভেজ রানা (জিপিএ-৪.২১)- দুজনেই ছোটবেলায় নিখোঁজ হয়ে আশ্রয় পান এখানে। সুজন আলী (জিপিএ-৪.১৪) বলেন, “বাবা-মার মুখ মনে আছে। কিন্তু জানি না কখনো তাদের কাছে ফিরে যেতে পারব কিনা। তাপস চন্দ্র রায় (জিপিএ-৩.৬৮) বাবাকে কখনো দেখেননি। শৈশবেই বাবা নিখোঁজ হন। এখনো মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ আছে।
বর্তমানে শিশু নগরীতে ১৬০ জন শিশু রয়েছে। অনেকেই পরিবারহীন, কেউ কেউ জানেন না নিজেদের শিকড় সম্পর্কে কিছুই।
শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, “এখানে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। মাধ্যমিক স্তরে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করা হয়।”এখন পর্যন্ত এখানে থাকা ২৪ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পাস করেছে।
শিশু নগরীর কৃষি কর্মকর্তা সেলিম প্রধান বলেন, “১৮ বছর পূর্ণ হলে এই শিশুদের কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।”
সেন্টার ম্যানেজার দীপক কুমার রায় বলেন, “আহছানিয়া মিশন অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের আলোর পথে নিয়ে আসে। এই বছর ১২ জন এসএসসি পাস করেছে—এটা আমাদের জন্য গর্বের।”
এসএসসি পাস করা প্রতিটি কিশোর এখন স্বপ্ন দেখে—নিজের পায়ে দাঁড়াবে, ভালো কিছু করবে, এবং কোনো একদিন হয়তো খুঁজে পাবে নিজের হারিয়ে যাওয়া পরিবার।