সেখানে শুক্রবার বেলা ১২ টার দিকে দেখা মিলে বিজিবির একটি কর্মসূচির ঘীরে অবস্থান করছিলেন একশোর কাছা-কাছি নানা বয়সী মানুষ। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় সীমান্তে স্থল মাইনে হাত-পা হারানো অন্তত ১৬ জন মানুষ। যারা এখন চিরতরে পঙ্গু।
ওখানে কথা হয় নুরুল আবছারের সাথে। যার বয়স এখন আঠারের নিচে। সীমান্তে স্থল মাইন বিস্ফোরণে ইতিমধ্যে হারিয়েছেন ডান পা। ক্রাচের উপর ভার করে চলা-ফেরা করেন।
তিনি নাইক্ষ্যংছড়ির জারাইলছড়ি সীমান্ত এলাকায় বসবাস করেন। তিনি জানান, স্থানীয় এক ব্যক্তির শ্রমিক হিসেবে মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে গরু আনতে গিয়ে এক বছর আগে স্থল মাইন বিস্ফোরণে পা হারান তিনি। শ্রমিক হিসেবে সামান্য মজুরির আসায় সীমান্তে গিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন। ঘটনার পর যে ব্যক্তির হয়ে গরু আনতে গিয়েছিলেন তিনি খবর নেননি। বিজিবির পক্ষে কিছু নগদ অর্থ সহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করছেন।
যেখানে ছিলেন রামু উপজেলার গর্জনিয়ার বাসিন্দা মো. আব্দুল্লাহ। এক বছর আগে সীমান্তের ওপারে গরু আনতে গিয়ে স্থলমাইনে হারিয়েছেন দুই পা। সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হলেন।
তিনি বলেন, কোন মানুষ যেন ভুলেও আর সীমান্তে না যান। এটা আশে-পাশের লোকজনকে এখন বলি। আমি ভুল করেছি, অন্যরা যেন ভুল না করেন।
ওই বিজিবির বিওপিতে মুলত ‘অঁইক্কা বোমা ফোডে, অঁড়ে আর ন যায়ুম’ শিরোনামে স্থল মাইন বিস্ফোরণ রোধে সীমান্তে না যাওয়ার প্রচারণা কর্মসূচি ঘিরে এদের জড়ো করা হয়েছিল। ওই দিন ওখানে বিজিবির মেডিকেল ক্যাম্পে স্থানীয়দের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি স্কুল শিক্ষার্থীদের দেয়া হয় শিক্ষা উপকরণ।
সেখানে পঙ্গু যারা ছিলেন তাদের সকলের গল্প কম বেশি একই ধরণের। এদের কেউ মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে অবৈধভাবে গরু, কেউ সিগারেট, কেউ মাদকসহ বিভিন্ন পণ্য আনতে গিয়ে স্থল মাইনের কবলে পড়েছেন। এর বিনিময়ে প্রতি গরু বাবদ দুই হাজার টাকা থেকে পণ্য মতো মজুরি প্রদান করা হত।
ওই কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস কে এম কফিল উদ্দিন কায়েস, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী ।
নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস কে এম কফিল উদ্দিন কায়েস জানান, নাইক্ষ্যংছড়ির ১১ বিজিবির আওতাধিন সীমান্ত এলাকায় ২০২৩ থেকে ২০২৫ পর্যস্ত স্থল মাইন বিস্ফোরণে ১৬ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ৩ জন, ২০২৪ সালে ৩ জন এবং ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১০ জন আহত হয়েছেন। এর প্রেক্ষিত গত এক মাস ধরে বিজিবির পক্ষে ‘অঁইক্কা বোমা ফোডে, অঁড়ে আর ন যায়ুম’ শিরোনামে স্থল মাইন বিস্ফোরণ হতাহত রোধে সচেতনতা কর্মসূচি করা হচ্ছে। এ প্রচারণার পর মানুষ এখন সীমান্তে যাওয়ার কমিয়েছে। ফলে এক মাসে নতুন করে স্থল মাইন বিস্ফোরণে আহতের কোন ঘটনা ঘটেনি।
তিনি স্বীকার করেন সীমান্তে অবৈধভাবে পন্য আনা-নেয়ার কাছে গেলেই এমন ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, এ অবৈধ পণ্য আনা-নেয়ার নেপথ্যে গডফাদারদের ইতিমধ্যে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সীমান্তে নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত শাহীন ডাকাত সহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নেয়া হয়েছে। অন্যদের ধরতে চেষ্টা চলছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এখানকার মানুষের সচেতনতা বা শিক্ষা যেহেতু আমরা পার্বত্য এলাকায় আছি। এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম, সচেতন মানুষের সংখ্যাও কম, শিক্ষার হারও কম। তবুও আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
আশারতলি সীমান্ত দিয়ে জামছড়ি দুই কিলোমিটার দূরে। আর জামছড়ি থেকে লেম্বুছড়ি সীমান্ত ৯ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ি উঁচু-নিচু এক দূর্গম এলাকা। যেখানে সীমান্ত সড়কের পাশে দেখা মিলেছে বন্য বানর, হাতি সহ বিভিন্ন প্রাণীর চলা-ফেরা। এই ১১ কিলোমিটার কিছু দূরে দূরে দেখা মিলে বিজিবির বিশেষ চৌকি, যেখানে ১২ ঘন্টা করে ২৪ ঘন্টা সর্তক অবস্থানে দায়িত্ব পালন করেন বিজিবি। দেখা মিলে এপিসি যান সহ বিশেষ বিজিবির টহলের।
আর এই দূর্গম পাহাড়ের সীমান্তের কিছু দূর যেতে দেখা যায় লাল পতাকা এবং সর্তকতামূলক বিল বোর্ড।
নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির সহকারী পরিচালক মো. আল আমিন বলেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে লাল পতাকা স্থাপনের মাধ্যমে সর্তকবার্তা জারি করা হয়েছে। যেখানে স্থল মাইন পুঁতে রাখার তথ্য রয়েছে। এগারো কিলোমিটার এলাকা ৩০ ঝুঁকি পূর্ণ পয়েন্টে শনাক্ত হয়েছে। সব স্থানে লাল পতাকা রয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পথ রোধ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিজিবি। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি বলেন, সীমান্ত এলাকার কাছা-কাছি যেন কোন মানুষ না যান তার জন্য বিজিবি এখন আগের চেয়ে কঠোর। ফলে এক মাসে হতাহতের কোন খবর নেই।
এর মধ্যে বিকাল অতিক্রম করে সময়। ফেরার পালা গন্তব্য কক্সবাজারে। ফেরার পথে একটি গ্রামে দেখা মিলে মাইকিং। বিজিবির পক্ষে সীমান্তে না যাওয়ার জন্য চালানো হচ্ছে প্রচারণা। বলা হচ্ছে ‘অঁইক্কা বোমা ফোডে, অঁড়ে আর ন যায়ুম’। অর্থ ওখানে বোমা ফাটে, ওখানে যাবো না।