সীমান্তের এই জনপদে একসময় রাত নামত অন্ধকারের চাদরে ঢেকে, কেবল কুপির আলো আর চাঁদের ক্ষীণ আভা ভরসা দিত মানুষের প্রাণে। পাহাড়-নদী ঘেরা উখিয়া-টেকনাফ যেন ছিল উন্নয়ন নামের শব্দটির বাইরে। এমন সময় আলহাজ্ব শাহজাহান চৌধুরীর আবির্ভাব। রাজনীতিকে তিনি কখনো ক্ষমতার আসনে বসিয়ে দেখেননি; দেখেছেন সেবার একটি মাধ্যম হিসেবে। তাঁর হাতে বিদ্যুতের সুইচ চাপতেই সীমান্ত জনপদে জ্বলে ওঠে আলো, আলোকিত হয় মানুষের ভবিষ্যৎ।
শাহজাহান চৌধুরীর বেড়ে ওঠা সাধারণ পরিবেশে। ছাত্রজীবনেই রাজনীতির প্রতি ঝোঁক তাঁকে যুক্ত করে জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে তিনি হয়ে ওঠেন উখিয়া-টেকনাফের অকৃত্রিম অভিভাবক। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ২৭ বছর বয়সে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করেন তিনি। এরপর আরও তিনবার মানুষ তাঁকে বেছে নেয় তাদের প্রতিনিধি হিসেবে। জাতীয় সংসদের হুইপের দায়িত্ব পালন করে তিনি পরিচিতি পান দেশের রাজনীতিতেও। কিন্তু তাঁর হৃদয়ের জায়গা ছিল সবসময় এখানকার সাধারণ মানুষদের জন্যই।
উখিয়া-টেকনাফবাসীর সবচেয়ে বড় স্মৃতির ভাণ্ডারে আছে বিদ্যুতের আলো। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর, দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে প্রথমবারের মতো গ্রামে পৌঁছায় বিদ্যুৎ। কৃষকের সেচযন্ত্র ঘুরতে শুরু করে, শিক্ষার্থীর পড়াশোনা এগোয় রাত জাগা প্রদীপের সীমা ছাড়িয়ে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নতুন স্বপ্নে বুক বাঁধে। আজও স্থানীয়রা গর্ব করে বলেন, “বিদ্যুতের আলো আমরা দেখেছি শাহজাহান চৌধুরীর হাত ধরে।”
শিক্ষাকে তিনি মনে করতেন জাতির মেরুদণ্ড। তাই তাঁর স্বপ্ন ছিল প্রতিটি শিশু, প্রতিটি কিশোর-কিশোরী যেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়। ১৯৯১ সালে তিনি গড়ে তুললেন উখিয়া ডিগ্রি কলেজ, এরপর টেকনাফ সরকারি কলেজ, উখিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাঁর উদ্যোগে নারী শিক্ষার প্রসার পায়, যা আগে এ অঞ্চলে ছিল বিরল। একসময়ের পিছিয়ে পড়া গ্রামগুলো থেকে এখন নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে আসছে—যা তাঁর স্বপ্নেরই বাস্তব রূপ।
যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও তাঁর অবদান অমলিন। এক সময়ের দুর্গম গ্রামগুলোর সঙ্গে শহরের সেতুবন্ধন ঘটাতে নির্মিত হয় সড়কপথ, যা মানুষের জীবনযাত্রাকে করে তোলে সহজতর। বাণিজ্য প্রসারের জন্য তিনি স্থাপন করেন টেকনাফ স্থলবন্দর, যা দক্ষিণ চট্টগ্রামের অর্থনীতিকে নতুন গতি দেয়। আর সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল পর্যটনশিল্পকে ঘিরে। সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ আজকের মেরিন ড্রাইভ সড়ক—যেখানে ঢেউয়ের সঙ্গী হয়ে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের পদচারণা।
তবে শুধু উন্নয়ন নয়, মানুষ তাঁকে মনে রাখে মানবিক রাজনীতিক হিসেবেও। ক্রীড়াঙ্গনে তরুণদের সম্পৃক্ত করা, নারীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া, তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়া—এসবই তাঁর সেবামূলক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। তিনি নিজেও খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যেন তরুণদের বলার মতো জীবন্ত উদাহরণ।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইতিহাসেও তাঁর নাম উচ্চারিত হয় গর্বভরে। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে কিংবা ১৯৯২-৯৩ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সময়ে, তাঁর প্রত্যক্ষ উদ্যোগ ও কূটনৈতিক তৎপরতায় কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা ফিরে যায় মিয়ানমারে। সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি আজও এক অবিস্মরণীয় সাফল্য।
রাজনীতির কঠিন সময়ে তিনি ছিলেন অটল। ১/১১-এর দুঃসময়েও তিনি সংগঠনকে ধরে রেখেছিলেন দৃঢ়ভাবে। অথচ ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন এক বিরল উদাহরণ—চারবারের সংসদ সদস্য, জাতীয় সংসদের হুইপ হয়েও নিজের নামে বাড়তি সম্পদ গড়ে তোলেননি। দলের প্রয়োজনে বিক্রি করেছেন পৈতৃক সম্পত্তি পর্যন্ত। এই ত্যাগ ও সততার কারণে আজও সাধারণ মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে।
Ads Image
উখিয়া-টেকনাফের প্রবীণরা বলেন, শাহজাহান চৌধুরী শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি ছিলেন মানুষের আস্থার বাতিঘর। তাঁর অবদান চোখে দেখা যায় প্রতিটি আলোকিত ঘরে, প্রতিটি স্কুল-কলেজে, প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে।
আজও তিনি রাজনীতির মাঠে সক্রিয়। ২০০৯ সালে ১৭ নভেম্বর থেকে অদ্যবধি কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি। আগামী নির্বাচনে তিনি আবারও দলের প্রার্থী হবেন—এই প্রত্যাশায় বুক বাঁধছে সীমান্তের মানুষ। তাঁরা চান, এবার তিনি শুধু এমপি নন, মন্ত্রী হয়ে তাঁদের জনপদকে আরও সমৃদ্ধ করবেন।
শাহজাহান চৌধুরী আসলে একটি নাম নয়, তিনি এক ইতিহাস। বিদ্যুতের আলো, শিক্ষার প্রসার, বাণিজ্যের বিকাশ, নারীর ক্ষমতায়ন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন—সবকিছুর মাঝেই তাঁর অবদান ছড়িয়ে আছে। রাজনীতিকে তিনি দেখেছেন সেবার অন্য নাম হিসেবে। তাই আজ যখন রাজনীতিতে আস্থাহীনতার কালো মেঘ জমে উঠছে, তখন তাঁর জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যিকারের রাজনীতি মানে মানুষের পাশে থাকা, মানুষের জন্য ত্যাগ করা, মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবের আলোয় রূপ দেওয়া।