পাঁচ বছর আগে স্বামী নেকবর আলী খান পরপারে চলে যান, রেখে যান চার ছেলে ও দুই মেয়ে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন স্ত্রী মমতাজ বেগম। শুধুমাত্র একটি ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছু না থাকায় সারাবছরই অভাব-অনটনের মধ্যে কেটেছে তাদের জীবন। বড় ছেলে মোফাজ্জলের সঙ্গে ছোট ছেলে তোফাজ্জল হোসেন ঢাকায় গিয়ে ষ্টিল বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু করে সংসার সামাল দিতে। তাদের পরিশ্রমে খানিকটা স্বস্তি ফিরেছিল পরিবারের জীবনে।
বাড়িতে প্রতিবন্ধী ছেলে রিফাত খান (১৫) ও আরেক ছেলে উজ্জল মিয়া থাকত।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার মিরপুর পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে মিছিলে-স্লোগানে মেতে ওঠেন তোফাজ্জল হোসেন। সেই দিনটিতে সকাল থেকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইট-পাটকেল ও উত্তেজনা চলতে থাকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে। বিকেল ৪টার দিকে পুলিশের সাতটি গুলিতে গুরুতর আহত হন তোফাজ্জল। মাথা, গাল ও ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি।
তোফাজ্জল রেখে গেছেন ১০ মাসের কন্যাশিশু তাশফিয়া ও স্ত্রী হামিদা খাতুনকে। এক মুহূর্তেই বিধবা হয়ে যান হামিদা। সন্তানকে বুকে আগলে নিয়ে শহীদ তোফাজ্জলের মা মমতাজ বেগম নিজের কষ্ট ভুলে ছেলের পরিবারকে আগলে রাখেন।
পরিবারে নতুন করে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজতে গিয়ে, ছয় মাস আগে ছোট ছেলে উজ্জল মিয়ার সঙ্গে ছেলের বিধবা স্ত্রী হামিদা খাতুনের বিয়ে দেন তিনি নিজেই এই সিদ্ধান্ত নেন, যাতে পরিবার ছিন্নভিন্ন না হয়, এবং শিশু তাশফিয়া একটি নিরাপদ শৈশব পায়।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ভালুকজান গ্রামের ফুলবাড়ীয়া আছিম সড়কের পাশে শহীদ তোফাজ্জলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি ভাঙাচোরা টিনসেট ঘরের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন মা মমতাজ বেগম। ছেলের স্ত্রী হামিদা খাতুন কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি গিয়েছেন।
সন্তান হারানোর বেদনায় নিঃশেষ মমতাজ বেগম ঘরে রাখা বাঁধাই করা একটি বইয়ের মলাট উল্টিয়ে দেখান কালো ফিতায় চিহ্নিত একটি ছবিতে রক্তমাখা শরীর নিয়ে পড়ে আছেন তার শহীদ সন্তান তোফাজ্জল। নিজে পড়তে পারেন না তিনি, তবু সেই বই বুকের কাছে আগলে রাখেন শুধু সন্তানের মুখখানি দেখার আশায়। ছবি দেখিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন ‘এই আমার তোরফাজ্জল… আমার ছেলে বইয়ের ভেতর রক্তমাখা হয়ে আছে, আমি তো তাকে জড়িয়ে ধরতেও পারি না…’।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।