কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে কিশোর অপরাধ, মাদক সেবন এবং অনলাইন জুয়ার প্রতি আসক্তির মতো ভয়াবহ প্রবণতা। এসব কর্মকাণ্ডে ছাত্র ও শিশু-কিশোরদের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষও।
মাদক গ্রহণ এবং অনলাইন জুয়ার প্রতি অতি মাত্রায় কিশোরদের এমন অন্তর্ভুক্তি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছালেও এসব মোকাবেলায় প্রশাসনের কার্যকর তদারকি বা উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি।
সরেজমিন দেখা গেছে, উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রাম-গঞ্জ, হাট-বাজার, এমনকি গ্রাম্য চায়ের দোকানেও স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের মধ্যে মোবাইল নিয়ে বসে অনলাইন গেম খেলা, জুয়া বা টিকটক লাইভে সময় কাটানোর মতো অভ্যাস বাড়ছে। বিষয়টি একদিকে যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার ক্ষতি করছে, তেমনি নৈতিক অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে।
সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় উখিয়ায় মাদকের ভয়াবহতা অনেক আগেই বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে। মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রায় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শোনা গেলেও, মাদক সেবনকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা হয় না। ফলে মাদক সেবনকারীরর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সঠিক পদক্ষেপের অভাবে সমাজে ক্রমাগত জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন মাদকসেবী, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
এদিকে মাদকসেবীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সমাজে বেড়ে চলেছে নানা অপকর্ম। মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে এসব মাদকসেবী জড়িয়ে পড়ছে চুরি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধে। এতে পরিবার, সমাজ ও এলাকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
এমন এক দৃশ্য দেখা গেছে, রত্নাপালং ইউনিয়নের ফৈজাবাপের পাড়া এলাকায়। স্থানীয় নিয়মিত মাদকসেবী এক যুবক মাদকের টাকা জোগাড় করতে এলাকায় প্রতিনিয়ত চুরি-ছিনতাইয়ের মতো কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে সে। এ নিয়ে তাকে হাতে নাতে ধরে গণপিটুনিও দিয়েছে এলাকার জনগণ।
তার পিতা আবু তাহেরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘সাগরের কারণে আমার মান সম্মান একেবারেই শেষ। তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। চুরি করতে গিয়ে তাকে কেউ মেরে ফেললে আমি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করব না। যেদিন থেকে সে খারাপ হয়ে গেছে, সেদিন থেকে আমার কাছে মৃত। আমি আর পারছি না তাকে নিয়ে।’
এছাড়াও মাদক সেবনের সাথে জড়িয়ে পড়ছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উখিয়ার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। জানা যায়, এসকল শিক্ষার্থী শুরুতে সিগারেটের মতো নেশা জাতীয় দ্রব্যের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পরে ধীরে ধীরে তারা আরও প্রাণঘাতী মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে রত্নাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা সময়ের কন্ঠস্বরকে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ ওয়ার্নিং দিতে পারি, আর কিছু পারি না। আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে এসব উপস্থাপন করে কিভাবে এসব প্রতিরোধ করা যায়, সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’
এদিকে উখিয়ায় দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে অনলাইন জুয়া। বিশেষ করে মোবাইল অ্যাপ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন জুয়ার মাধ্যমে কিশোর-তরুণরা সহজে ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। অনেকেই প্রথমে ছোট অঙ্কে খেলে শুরু করলেও পরে আসক্ত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। পারিবারিক সঞ্চয়, শিক্ষার খরচ এমনকি ধার-দেনা করে টাকাও খরচ করছে এই জুয়ায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা চটকদার বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে পড়ে এসব অনলাইন জুয়াই আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্করাও।
অনলাইন জুয়ায় নিঃস্ব হওয়া এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম ঘরে বসে একটি কাজের সুযোগ হয়েছে। ওয়াইনএক্স বিটের যে ক্যাসিনো আছে সেখানে প্রথমে ৫০০ টাকার বিনিময়ে ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করি।
তিনি আরও জানান, ‘পরে আমার দুইটি মোবাইল থেকে একটি মোবাইল বিক্রি করা টাকা দিয়ে আবারও জুয়াই বিনিয়োগ করি। তবে এবার লাভতো দূরের কথা উল্টো সর্বস্ব হারায়।’
ভালুকিয়া স্কুলে পড়ুয়া ছাত্র ইয়াসিন আরফাত সোহেল নামে এক শিক্ষার্থীর কাছে অনলাইন জুয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বলে, ‘আমার অনেক বন্ধুবান্ধব খেলে। আমি খেলি না। বাড়িতে মোবাইল চেক করে নিয়মিত। কোনো অনলাইন গেম বা জুয়া সাইটের অ্যাপ আছে কি না।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনলাইনে জুয়া খেলার অপরাধে জড়ানোর মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো, অল্প বয়সেই হাতে স্মার্টফোন থাকা, মা-বাবার পর্যাপ্ত তদারকি না থাকা, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং বিকল্প কোনো গঠনমূলক কার্যক্রমের অভাব।
এ বিষয় নিয়ে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা উখিয়া থানার ওসি আরিফ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সময়ের কন্ঠস্বরকে বলেন, ‘অনলাইন জুয়ার বিষয়ে অপরাধী শনাক্ত করতে অনেক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়, যা আমাদের নেই। তারপরও ডকুমেন্টস নিয়ে কেউ অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
এদিকে মাদক ও জুয়ার চেয়েও বর্তমানে আরও মারাত্মক আসক্তিতে পরিণত হয়েছে অনলাইন গেম। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এই গেমে বিপুল পরিমাণ সময় ব্যয় করছে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ও মানসিক বিকাশে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এই ভয়াবহ আসক্তি রোধে অভিভাবকদের সচেতন তদারকি এবং শিক্ষকদের সক্রিয় ভূমিকা পালন এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ অনলাইন গেম ফ্রি ফায়ার, পাবজি সহ নানা ধরনের গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
স্থানীয় শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা এখন মোবাইলে আসক্ত। পড়ার চেয়ে তাদের আগ্রহ গেম বা লাইভ স্ট্রিমিংয়ে। পড়ালেখার মান কমে গেছে, পরীক্ষার ফলাফলেও তার ছাপ স্পষ্ট। অনেক সময় দেখা যায়, রাত জেগে ফোনে গেম খেলছে বা জুয়া খেলছে, সকালে ক্লাসে ঘুমাচ্ছে।’
উখিয়া নাগরিক সুশাসন কমিটির সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে প্রশাসনের নিয়মিত অভিযান থাকলেও অনলাইন আসক্তি বা জুয়ার বিরুদ্ধে নেই কোনো জনসচেতনতা কর্মসূচি কিংবা প্রযুক্তিভিত্তিক তদারকি। এসবের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে উখিয়ায় কিশোর অপরাধ ও নেশাগ্রস্ত প্রজন্ম তৈরি হবে— যা পুরো সমাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।’