দুবাইয়ের আলো ঝলমলে জীবনের আড়ালে চলছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। একটি আন্তর্জাতিক নারী পাচার ও যৌন শোষণের চক্রের নেতৃত্বে আছেন একজন সাবেক বাসচালক, যিনি এখন বিলাসবহুল যৌন পার্টির ‘সাপ্লায়ার’। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, উগান্ডা থেকে আসা নারীদের নানা প্রলোভনে এনে তাঁদের দিয়ে চালানো হচ্ছে অবমাননাকর যৌন কাজ।
এই চক্রের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন চার্লস মোসিগা, যিনি নিজেকে লন্ডনের প্রাক্তন বাসচালক হিসেবে পরিচয় দেন। অনুসন্ধানকারী দলের এক ছদ্মবেশী প্রতিবেদককে মোসিগা সরাসরি বলেন, তিনি এক হাজার ডলার থেকে শুরু করে বিভিন্ন মূল্যে নারী সরবরাহ করতে পারেন—এবং অনেক নারী “প্রায় সবকিছু” করতেও প্রস্তুত।
মিথ্যা আশায় ফাঁদে পড়ে যৌন দাসত্ব
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উগান্ডার দরিদ্র পটভূমি থেকে আসা অনেক নারী বিশ্বাস করেছিলেন, তাঁরা দুবাইয়ে গিয়ে হোটেল বা সুপারমার্কেটে কাজ করবেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁদের ঠাঁই হয় যৌন বাণিজ্যে।
‘মিয়া’ (ছদ্মনাম) নামের এক নারী বলেন, তিনি নিজে ফিরে যেতে চাওয়ার পর মোসিগা সহিংস হয়ে ওঠেন। তাঁকে জানানো হয়, ভিসা, বাসা ও অন্যান্য খরচ বাবদ তিনি ২৭০০ ডলারের ঋণের ভারে ডুবে আছেন—যা সময়মতো না পরিশোধ করলে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, একজন নিয়মিত ক্লায়েন্ট মেয়েদের গায়ে মলত্যাগ করতে চাইতেন এবং তা খাওয়াতে বলতেন। এমন বিকৃত যৌন চাহিদা পূরণের জন্য তাঁদের বাধ্য করা হতো।
মৃত্যু, নিপীড়ন ও বিচারহীনতা
অনুসন্ধান বলছে, মোসিগার সঙ্গে সম্পৃক্ত দুই নারী রহস্যজনকভাবে সুউচ্চ ভবন থেকে পড়ে মারা যান। তাঁদের একজন, মোনিক কারুঙ্গি, পশ্চিম উগান্ডা থেকে এসেছিলেন। প্রথমে তাঁকেও জানানো হয়েছিল, তিনি সুপারমার্কেটে কাজ করবেন। পরে বুঝতে পারেন, তিনি যৌন বাণিজ্যের একটি অংশ হয়ে গেছেন।
মোনিক মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ফ্ল্যাট ছেড়ে নতুন কাজ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু ২০২২ সালের ১ মে হঠাৎই একটি ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে পড়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে। পরিবারের দাবি, এটা আত্মহত্যা নয়—বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হতে পারে।
মাইকেল, মোনিকের আত্মীয়, অভিযোগ করেন, দুবাই পুলিশ তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানায়। পুলিশ জানায়, ফ্ল্যাটে মাদক ও অ্যালকোহল ছিল এবং বারান্দায় শুধু মোনিকের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।
পুলিশি উদাসীনতা ও বর্ণবাদী আচরণ
আরেক ভুক্তভোগী লেক্সি বলেন, পুলিশের কাছে সাহায্য চাইলে বলা হয়, “তোমরা আফ্রিকানরা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা তৈরি করো।” এরপর পুলিশ ফোন কেটে দেয়।
লেক্সি বিশ্বাস করেন, এই চরম বিকৃত যৌন চাহিদার পেছনে জাতিগত বিদ্বেষ কাজ করে। তিনি বলেন, “তাঁরা এমন কাউকে খুঁজতেন, যে কাঁদবে, চিৎকার করবে, পালাতে চাইবে—একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী।”
‘মোসিগা এখনো ধরা–ছোঁয়ার বাইরে’
মোসিগার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। বলেন, তিনি শুধু নারীদের বাসা ভাড়ায় সহায়তা করেন এবং পার্টিতে নিয়ে যান, কারণ তাঁর ধনীদের সঙ্গে পরিচয় আছে।
কিন্তু অনুসন্ধানী দল ছদ্মবেশী প্রতিবেদক পাঠিয়ে জানতে পারে, তিনি সরাসরি নারী সরবরাহে জড়িত। মোসিগা জানান, তাঁর ‘স্টকে’ প্রায় ২৫ জন মেয়ে আছে, যারা ‘খুবই মুক্তমনা’। বিলাসবহুল পার্টির জন্য প্রতিটি নারীর মূল্য ন্যূনতম এক হাজার ডলার।
মরদেহও পেল না পরিবার
মোনিকের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। অনুসন্ধানে জানা যায়, তাঁকে দুবাইয়ের আলকুসাইস কবরস্থানে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ হিসেবে দাফন করা হয়েছে।
বাঁচতে পেরেছেন, এখন লড়ছেন
মেয়ে পাচার ও যৌন শোষণের শিকার হওয়া লেক্সি ফিরে এসেছেন উগান্ডায়। এখন তিনি অন্যদের সহায়তায় কাজ করছেন। তাঁর সংগ্রাম বলছে, এই চক্র শুধু যৌন শোষণের নয়—মানবাধিকারের নির্মম লঙ্ঘনের প্রতীক।
(সূত্র: বিবিসি)