রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হলে তা বৈশ্বিক সমস্যায় রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেছেন, “এই সংকটের সমাধান না করা গেলে আগামীদিনে এটি আর শুধু বাংলাদেশের সমস্যা হিসেবেই থাকবে না; বরং একটি আঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক সমস্যায় রূপ নিতে পারে।”
শুক্রবার ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘বেঙ্গল ডেল্টা সম্মেলনে’ বক্তব্য দিচ্ছিলেন তৌহিদ।
তিনি বলেন, “আগামী ২০ বছরে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অনেক পরিবর্তন দেখতে হতে পারে৷ এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে যদি বলি, বাংলাদেশের দিক থেকে এটা সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন।”
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন বলে মনে করেন তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “আমাদের দিক থেকে এই সংকটের কোনো সমাধান নেই এখন। প্রায় ৮ বছর হয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে সবাই ভেবেছিল এটা হয়ত এক-দুই বছরের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে। আমি নিজেও তাই ভেবেছিলাম।
“কিন্তু, এটা পুরোপুরি ভিন্ন একটা বৈশ্বিক খেলা। আমি বলব, এর জন্য ১৫ বছরের জন্য একটা পরিকল্পনা করতে হবে। যাতে এই সময়ের মধ্যে আমরা এই সংকটের সমাধান করতে পারি।”
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সেই ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট; এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
গেল আট বছরে এ সংকট সমাধানে কোনো অগ্রগতি হয়নি মন্তব্য করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আট বছর চলে গেছে, কিন্তু কিছুই হয়নি। আমরা এখনো চেষ্টা করছি, যাতে কিছু করা যায়।
“এটা এমন একটা সমস্যা, যেটা একসময় বাংলাদেশের জন্য আংশিক সমস্যা ছিল। কিন্তু এখন এটা পুরোপুরি বাংলাদেশের সমস্যা।”
এ সংকট দীর্ঘতর হলে কেবল যে বাংলাদেশই ভুগবে না তাও তুলে ধরেছেন তৌহিদ হোসেন।
তার ভাষ্যে, “আমি এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই সমস্যা কিন্তু শুধু বাংলাদেশের থাকবে না, যদি আগামী ৮ বছরও এভাবেই কাটে। এটা হবে আঞ্চলিক সমস্যা। এমনকি আঞ্চলিক গণ্ডিও ছাড়িয়ে যেতে পারে।”
এর কারণ ব্যাখ্যায় উপদেষ্টা বলেন, “কারণ, যে রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েরা ৫ থেকে ১০ বছর বয়সে তাদের পিতামাতার সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছে, তাদের অনেকেই কৈশোরে পা রেখেছে। অনেকেই কৈশোরও পার করে ফেলেছে।
“তাহলে এই লাখো ছেলে-মেয়ে, বিশেষ করে ছেলে তাদের এই রিফিউজি ক্যাম্পের যাযাবরের জীবনে মেনে হবে? যেখানে কোনো আশা নেই, কোনো ভবিষ্যতের আলো নেই।”
তৌহিদ বলেন, “তারা কিন্তু তাদের রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করবে। যখন তারা সেটা করবে, তখন এটা বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যার পাশাপাশি এশিয়ার এই অঞ্চলেও বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে।
“সুতরাং, শুধু বাংলাদেশ আর রোহিঙ্গাদের স্বার্থেই নয়, আঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে ধরে নিয়েই এই সংকটের সমাধান করতে হবে।”
ভূ-রাজনীতি প্রসঙ্গ
আলোচনায় চলমান বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়েও কথা বলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
“পরিবর্তন তো সবসময়ই আসে। তবে সম্প্রতি দ্রুতই বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। আমি যদি বলি, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, গাজায় গণহত্যা, পাশাপাশি ইসরায়েল-আমেরিকার ইরানে আক্রমণ এবং সবশেষ মার্কিন শুল্ক যুদ্ধ,” বলছিলেন তৌহিদ।
গাজায় গণহত্যাকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এই বিষয়গুলো বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আমরা যদি গাজার গণহত্যার দিকে তাকাই, আমরা বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখতে পাই যে- সবশেষ এক দুই-বছরে ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন।
“আমি দক্ষিণের কথা বলছি না, কারণ আমরা সবাই ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি জানাচ্ছি। কিন্তু, প্রথমবারের মতো খোদ আমেরিকারই ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ মনে করে- ফিলিস্তিনে ইসরায়েল গুরুতর অপরাধ চালাচ্ছে। তাই আমি মনে করি এটা একটা বড় পরিবর্তন।”
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আমি আরও একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি, মার্কিনঘেঁষা বুদ্ধিজীবীরাও গাজায় গণহত্যার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন।
“এরপর আসি মার্কিন শুল্কের প্রসঙ্গে; যেটা বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করেছে। বিশ্ব রাজনীতিতে এই শুল্কও একটা বড় পরিবর্তন এনেছে।”
ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের রপ্তানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা ওয়াশিংটনের কৌশলগত অংশীদারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত কয়েক দশকে দেশ দুটির সম্পর্ক উষ্ণ হলেও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শুল্ক নিয়ে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে; আর তাতে জোরদার হয়েছে ভারত ও চীনের সম্পর্ক।
নয়া দিল্লি ও বেইজিংয়ের সাম্প্রতিক রসায়ন নিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক যেটা চীনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। এতদিন দুই দেশের ভালো সম্পর্ক থাকলেও হঠাৎই অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এবং চীনের প্রেসিডেন্ট প্রায় একই ভাষায় কথা বলছেন।
“তো, আসলেই আমরা কী বিভিন্ন দেশের সম্পর্কে নতুন রসায়ন দেখতে পাচ্ছি? আমি বলব, না, ভূরাজনীতির মূল বিষয়গুলোতে এখনো কোনো পরিবর্তন আসেনি। যে পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা হয়ত স্থায়ী নাও হতে পারে।”
‘সামনে সময় এশিয়া-আফ্রিকার’
চলতি শতকের ভূ-রাজনীতিতে এশিয়ার আধিপত্য থাকতে পারে বলে মনে করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তার ভাষায়, “একবিংশ শতাব্দীতে আধিপত্য থাকতে পারে এশিয়ার। কারণ, বিংশ শতাব্দীতে ছিল অনেকটা যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য। এই ধারা পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। কোনোভাবেই কেউ এটা আটকাতে পারবে না। কিন্তু তার মানে এই না যে- এটার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ব রাজনীতিতে পুরোপুরি পরিবর্তন আসবে।”
তৌহিদ বলেন, “সম্ভবত দ্বাবিংশ শতাব্দীতে আধিপত্য থাকতে পারে আফ্রিকার। কারণ আফ্রিকাই একমাত্র মহাদেশ- যেখানে যথেষ্ট মানুষ আছে। শুধু তারা তাদের যে অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, সেটার ওপর যদি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসতে পারে…যেসব সম্পদের ওপর বর্তমানে তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।
“আমি আফ্রিকার অনেকগুলো দেশে ঘুরেছি। আমি দেখেছি, তাদের এসব সম্পদে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই যদি তারা তাদের এসব সম্পদের ওপর সামান্য হলেও নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, তাহলে দ্বাবিংশ শতাব্দীতে ভূ-রাজনীতিতে তাদের আধিপত্যই বেশি থাকবে। যদিও এটা অনেক পরের কথা।”
দুই দিনের এই সম্মেলনের প্রথম দিনে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ মুশতাক এইচ খান।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন- মালয়েশিয়ার সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও আন্তর্জাতিক ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান মাস্জলি বিন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান, নেপালের সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী দীপক গেওয়ালি, দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ বরদারাজন।
সম্মেলনের প্রথম দিনে নদীভিত্তিক ভূগোল, অর্থনৈতিক কৌশল, রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে একাধিক সেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।