আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ সভায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) কমিশনারের নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট একটি নথি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এই নির্দেশনাটি ব্যাপকভাবে ভাইরাল করে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। এতে সমালোচনার মুখে পড়েছেন এসএমপি কমিশনার আব্দুল কুদ্দুছ চৌধুরী।
পুলিশের এই অভ্যন্তরীণ সভার কার্যবিবরণী জনসমক্ষে আসার কথা ছিল না। কিন্তু কার্যবিবরণীর মধ্যে যে অংশে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত, সেই অংশটিই ফাঁস করা হয়েছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে তাহলে পুলিশের ভেতরে এখনো কি আওয়ামী দোসরদের অবস্থান রয়েছে? তা না হলে পুরো নথিটি ফাঁস না করে কেবল আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট অংশই কেন ফাঁস করা হলো?
অবশ্য পুলিশ বলছে, এটি কীভাবে ফাঁস করা হয়েছে, কারা ফাঁস করেছে সবকিছুই অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
প্রশাসনিক নথি বা অফিস আদেশ কিংবা অভ্যন্তরীণ সভার কার্যবিবরণী ফাঁস হওয়া কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। সাধারণত এসব তথ্য কেবল সংশ্লিষ্ট বা নির্দিষ্ট পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু এই ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, পুলিশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণে একটি বড় ধরনের ফারাক তৈরি হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরকম কোনো সিদ্ধান্ত সংবিধানবিরোধী কাজ। আর তথ্য ফাঁস এক ধরনের নাশকতামূলক কাজ। একটি বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এ ধরনের কাজ করা হয়েছে।
গত শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণীর ১৩ নম্বর ও সর্বশেষ সিদ্ধান্তটিই ফেসবুকে ছড়িয়েছে।
ছড়িয়ে পড়া ওই নির্দেশনায় লেখা রয়েছে, ‘ডিসেম্বর/২০২৫ খ্রি. মধ্যে এসএমপির আওতাধীন এলাকায় কোনো আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের লোকজন প্রকাশ্যে যাতে এলাকায় না থাকতে পারে, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সব অফিসার ইনচার্জকে নির্দেশনা প্রদান করা হলো। এসি, এডিসি ও ডিসিরা এ বিষয়ে তদারকি করবেন।’
গত শনিবারের সভার এই কার্যবিবরণী পরদিন রোববার এসএমপির ছয় থানার ওসিসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়।
ফাঁস হওয়া কার্যবিবরণীর ১৩ নম্বর ও সর্বশেষ সিদ্ধান্তটি হলুদ রঙের মার্কার দিয়ে হাইলাইট করা এবং এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে ডিসি দক্ষিণ লেখাটিও একই রঙে চিহ্নিত করা। তাছাড়াও অনুলিপি যাদের কাছে পাঠানো হয়েছে সেখানেও উপপুলিশ কমিশনারের (দক্ষিণ) নামে ঠিক চিহ্ন দেওয়া।
ধারণা করা হচ্ছে এই নথিটি এসএমপির উপপুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এর কার্যালয় থেকেই ফাঁস করা হয়েছে। নতুবা চিঠি পাঠানোর সময় কোনো মাধ্যমে এটি ফাঁস হয়েছে। এ ঘটনার পর পুলিশ প্রশাসনের ভেতরে এখনো দলীয় আনুগত্যের বিভাজনের বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রশাসনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা দলীয় দোসররা শুধু অভ্যন্তরীণ গোপনীয়তাই ক্ষুণ্ন করছেন না, বরং সরকারের প্রতি জনআস্থা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে পুলিশ কমিশনারের নামে ছড়িয়ে পড়া একটি নির্দেশনাকে ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য’ বলছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি)। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই নির্দেশনা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে মঙ্গলবার এসএমপির ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়।
ফেসবুকে দেওয়া ওই পোস্টে বলা হয়- ‘সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যক্তি ফেসবুকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের নির্দেশনা বলে একটি বক্তব্য লিখে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন। প্রকৃত তথ্য হলো পুলিশ কমিশনার মহোদয় অফিসারদের অভ্যন্তরীণ সভায় নিম্নোক্ত বক্তব্য দিয়েছেন। বিভ্রান্তিকর তথ্যে বিভ্রান্ত না হতে সকলকে অনুরোধ করছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, পুরো ঘটনাটি আমরা খতিয়ে দেখছি। এটি কীভাবে ফাঁস হলো, কারা এটা ফাঁস করেছে সবকিছু অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
ফাঁস হওয়া নথিতে উপপুলিশ কমিশনারের (দক্ষিণ) নামের ওপর টিক চিহ্ন দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি চিঠি প্রেরণের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পদবিতে টিক চিহ্ন দেওয়া হয়। আলাদা করে নাম অনুসারে করা হয় না। একই চিঠিতে প্রত্যেকের জন্য আলাদা টিক চিহ্ন দিয়ে পাঠানো হয়। কার হাত থেকে এটি ফাঁস হয়েছে, এটি বের করতে অনুসন্ধান চলছে।
সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আশিক উদ্দিন বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড নাশকতার পর্যায়ে পড়ে। কোনো অবস্থাতে এ ধরনের তথ্য বাইরে প্রকাশ করা যায় না। এ ধরনের কাজ শুধুমাত্র কোনো ব্যক্তিকে না সরকারকে বিব্রত করা হয়।
তিনি বলেন, যারা এগুলো করছে তারা আওয়ামী লীগের দোসর। সাধারণ মানুষের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে পুলিশকে বিতর্কিত করার জন্য এ কাজ করছে। আইনত দৃষ্টিতে এ ধরনের অপরাধ যে করেছে, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে কিংবা মামলাও দায়ের করতে পারবে বলে জানান তিনি।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সারোয়ার আহমদ চৌধুরী আবদাল বলেন, যদি এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে এটা সংবিধানবিরোধী। আর যারা এটা ফাঁস করেছে, এটা খুবই গর্হিত কাজ করেছে। এটা সম্পূর্ণ আইনের পরিপন্থি।