২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ঢল পেরিয়েছে আট বছর। সেই সময়টাতে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ভূগোল বদলে গেছে। সীমিত আট হাজার একরের বনভূমিতে গড়ে ওঠা ৩৩টি ক্যাম্পে এখন গাদাগাদি করে বসবাস করছে ১৪ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।
সরকারি হিসাবে নিবন্ধিত সংখ্যা ১১ লাখ ৪৮ হাজার ৫২৯ হলেও অনিবন্ধিতসহ এ সংখ্যা অনেক বেশি। শুধু ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “প্রতিদিন গড়ে ৮৭ জন শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পে। বছরে প্রায় ৩০ হাজার। আট বছরে জন্ম নিয়েছে দুই লাখ ৪০ হাজারের বেশি শিশু। সীমিত জায়গায় লাখ লাখ মানুষ বসবাস করছে। কিন্তু নতুন ক্যাম্প করার সুযোগ নেই। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো সমাধান নেই।”
নতুন জন্ম ছাড়াও অনুপ্রবেশ থেমে নেই। রোহিঙ্গা নেতা দীল মোহাম্মদ দাবি করেছেন, গত এক বছরে দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে। স্থানীয় সূত্র বলছে, এসব রোহিঙ্গার মধ্যে অনেকেই শহরের ভেতরেও বসতি গড়ে তুলেছে। সরকারি নিবন্ধনের বাইরে থাকা এ জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই।
এদিকে ক্যাম্পে জনসংখ্যা বাড়লেও পরিবার পরিকল্পনায় রোহিঙ্গাদের আগ্রহ প্রায় নেই বললেই চলে। এনজিও কর্মীরা জানান, রোহিঙ্গা দম্পতিরা জন্মনিয়ন্ত্রণে খুবই অনাগ্রহী। কেউ কেউ একাধিক স্ত্রী রাখেন এবং প্রতিটি পরিবারে গড়ে সাত থেকে আটজন সন্তান রয়েছে। এক এনজিও কর্মীর ভাষায়, “অনেক পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৭-৮ জন। সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করলেও সাড়া পাওয়া যায় না।”
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জানিয়েছে, কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে শিশু আছে প্রায় ছয় লাখ। এর মধ্যে পাঁচ বছরের নিচে রয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার শিশু। শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মক সংকটে পড়েছে। অর্থ সংকটের কারণে গত জুনে চার হাজার ৫০০ লার্নিংসেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে প্রায় দেড় লাখ শিশু পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়েছে। চাকরি হারিয়েছেন স্থানীয় এক হাজার ১৭৯ শিক্ষক।
ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স এ বিষয়ে বলেন, “আমি ৩০ বছরের কর্মজীবনে এত ভয়াবহ অর্থ সংকট দেখিনি। ফিলিস্তিনসহ অন্যত্র বিশ্ব মনোযোগ চলে গেছে। ফলে রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া শিশুরা আরও বেশি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।”
শিক্ষার অভাবের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। মাতৃস্বাস্থ্য প্রকল্প ব্যাহত হচ্ছে, শিশু পুষ্টি কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পথে। এনজিও সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে একজন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা শিশুরা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে, যা তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আন্তর্জাতিক রেসকিউ কমিটির (আইআরসি) হিসাবে, এ বছর বাল্যবিয়ে বেড়েছে ৩ শতাংশ এবং শিশুশ্রম বেড়েছে ৭ শতাংশ। নজরদারি সীমিত হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিক্ষক ও অভিভাবকদের ভাষ্যমতে, স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিশুরা এখন অলস সময় কাটাচ্ছে, কেউ দিনমজুরের কাজে নামছে, আবার কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে আছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, এ বছর রোহিঙ্গাদের সহায়তায় দরকার ২৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি মিলেছে মাত্র ৩৮ শতাংশ। ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি জুলিয়েট মুরেকেইসনি বলেন, “এই শরণার্থীরা আগেই সব হারিয়েছে। এখন তহবিল সংকটে জীবন রক্ষাকারী কাঠামো ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে আছে। খাবার, স্বাস্থ্যসেবা, রান্নার গ্যাস, সাবান আর শিক্ষা—সবই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”
আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। বরং অনুপ্রবেশ ও জন্মহার মিলিয়ে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও আস্তে আস্তে ধসে পড়ছে, তহবিল সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। তারা বাংলাদেশে জন্ম নিচ্ছে, ফলে তাদের কোনো নাগরিকত্বও নেই। ফলে রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চিত অন্ধকারেই আটকে আছে।