দক্ষিণ কক্সবাজারের জনপদে একসময় একটি নাম ছিলো রুমখাঁ বাজার। শতবছরের ঐতিহ্যবাহী এই হাটবাজার ছিলো উখিয়া উপজেলার মানুষের জীবন-জীবিকার অংশ। সপ্তাহে দুই দিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার বাজারটি জমে উঠতো প্রাণচাঞ্চল্যে। কৃষক, জেলে, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ সকলেই ছুটে আসতো এখানেই।
তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সেই রুমখাঁ বাজার হাটের কোলাহল। আধুনিকতা, যাতায়াত ব্যবস্থার পরিবর্তন, এবং নতুন নতুন বাজার গড়ে ওঠার ফলে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায় সেই হাট বাজার। আজ সেখানে নেই আগের মতো মানুষের ভিড়, নেই পণ্যের রাশি। আছে শুধু পুরনো কিছু স্মৃতি, ভাঙা কাঠামো, আর একজন মানুষের দৃঢ়তা তার নাম আব্দুল গফুর।
স্থানীয় প্রবীণরা জানান, রুমখাঁ বাজার ছিলো দক্ষিণ কক্সবাজারের সবচেয়ে পুরোনো এবং গুরুত্বপূর্ণ হাটবাজারগুলোর একটি। আশপাশের ১৫-২০ কিলোমিটার এলাকার মানুষজন নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছু এই বাজার থেকেই সংগ্রহ করতো।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যবসায়ীরা বলেন,”এই বাজারে একসময় পাঁচশোর বেশি দোকান বসতো। মাছ, তরকারি, চাল, কাঠ, মাটি, এমন কিছু ছিলো না যা এই বাজারে মিলতো না। এখন সবই কেবল স্মৃতি।”
মনির মার্কেট এলাকার স্থানীয়রা জানান,”রুমখাঁবাজার হাটে যাওয়ার দিন মানে ছিল উৎসবের দিন। সকালে হাটে গিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতাম। এখন সেখানে গেলে মনটা খালি খালি লাগে।”
রুমখাঁ আব্দুলগণি পাড়ার বাসিন্দা আব্দুল গফুর বিগত চার দশক ধরে রুমখাঁ বাজারেই ব্যবসা করে আসছেন। অন্য সবাই যখন ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন, তখনও তিনি রয়ে গেছেন তার পুরনো দোকান নিয়ে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রুমখাঁ বাজারে এখন কোনো স্থায়ী দোকান নেই। চারপাশে নিরবতা। তবে বাজারের এক কোণে একটি ছাউনির নিচে সাজিয়ে রাখা রয়েছে কিছু সবজি আলু, শসা, মুলা, লাউ, শিম, কচু, টমেটো, বেগুন। পাশেই হাসিমুখে বসে আছেন আব্দুল গফুর। তাঁর চোখেমুখে ক্লান্তি থাকলেও, মনোবলে যেন কোনো ঘাটতি নেই। আব্দুল গফুর বলেন,”বাবা-চাচারা সবাই এই বাজারে ব্যবসা করতেন। ছোটবেলা থেকে এখানেই বড় হয়েছি। তখন যে কোলাহল ছিল, তা ভাবলেও এখন গায়ে কাঁটা দেয়। সবাই চলে গেলো, কিন্তু আমি পারলাম না। মনের টানে রয়ে গেলাম।” তিনি জানান, এখন আর আগের মতো ক্রেতা নেই। তবে প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার নিজ হাতে ভোরে সবজি সংগ্রহ করে দোকান খুলে বসেন। আয় রোজগার কম হলেও তিনি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন শুধু একটি কারণেই। তিনি এই বাজারের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে চান।
রুমখাঁ বাজারের ইতিহাসের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের অনেকেই আজ আব্দুল গফুরকে সম্মান জানিয়ে বলেন, তিনি শুধু একজন ব্যবসায়ী নন, তিনি একটি ঐতিহ্যের ধারক।
স্থানীয়রা বলেন,”আমরা ছোটবেলায় গফুর চাচার দোকান থেকেই সবজি কিনতাম। আজও উনি রয়ে গেছেন। তাঁর মতো মানুষের কারণেই ইতিহাসের টুকরো টুকরো অংশ এখনও আমাদের চোখে ধরা দেয়।” স্থানীয় সচেতন মহল জানায়,”রুমখাঁ বাজারকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একটা পরিকল্পনা নেয়া উচিত। গফুরের মতো মানুষদের পাশে দাঁড়ানো দরকার, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুঝতে পারে, তাদের পূর্বপুরুষদের জীবন ছিল কতটা বর্ণিল।”
রুমখাঁ বাজার এখন কেবলই একটি নাম। তার প্রাণ, কোলাহল, গন্ধ সবই সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে। কিন্তু আব্দুল গফুরের ছোট্ট দোকানটি যেন সেই সব কিছুর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিকতার ঢেউয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রবীণ যোদ্ধা, যিনি নিজের হাতে ধরে রেখেছেন অতীতকে।
উখিয়ার রুমখাঁ বাজার হয়তো আর আগের মতো হবে না। কিন্তু এই গল্প, এই সংগ্রাম, এই ভালোবাসা সবই বলে দেয়, ঐতিহ্য কখনো পুরোপুরি মুছে যায় না, যদি কিছু মানুষ তাদের হৃদয়ে সেটাকে ধারণ করে রাখেন।