ব্যক্তিগত প্রাইভেটকারে চড়ে রাউজানের গ্রামের খামারবাড়ি থেকে চট্টগ্রাম শহরে ফিরছিলেন আবদুল হাকিম। কাপ্তাই সড়ক হয়ে যাচ্ছিল গাড়িটি। তিনি বসা ছিলেন চালকের পাশের আসনে। হাটহাজারীর মদুনাঘাট এলাকায় পৌঁছলে একদল মোটরসাইকেল আরোহী অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গাড়িটির পিছু নেয়। তারা গাড়িটি নজরে রাখতে থাকে।
একপর্যায়ে হাটহাজারীর দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের মদুনাঘাট বাজারের পানি শোধনাগার মূল ফটকের সামনে পৌঁছালে অস্ত্রধারীরা গাড়ি লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবদুল হাকিম মারা যান। গুলিবিদ্ধ হন গাড়িচালকও।
গতকাল মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার এ ঘটনা ঘটে। নিহত আবদুল হাকিম (৫২) বিএনপির কর্মী ছিলেন। ঘটনার মুহূর্তের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভিডিওতে দুজনকে দেখা গেলেও গাড়ির আশপাশে আরও কয়েকজন অস্ত্রধারী ছিল।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাটহাজারীর মদুনাঘাট বাজারের পানি শোধনাগার কেন্দ্রের মূল ফটকের সামনে থেকে আনুমানিক ২০০ মিটার দূরে একটি পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ৯ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখা যায়, সাদা রঙের প্রাইভেটকারটি পানি শোধনাগারের সামনে দাঁড়ানো ছিল। ভিডিওতে অন্তত পাঁচটি গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। গুলি করা ব্যক্তির পাশে হেলমেট পরা আরেকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয়রা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুজনকে উদ্ধার করে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আবদুল হাকিমকে মৃত ঘোষণা করেন।
মদুনাঘাট পুলিশের একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, সন্ত্রাসীরা চারটি মোটরসাইকেলে আসে। চার-পাঁচ মিনিটের কম সময়ের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটে। কয়েক মিনিটে সন্ত্রাসীরা ১০-১২টি গুলি ছোড়ে। এরপর তারা দ্রুত পালিয়ে যায়। ১০ মিনিট পরই ঘটনাস্থলে পৌঁছান পুলিশ সদস্যরা।
আবদুল হাকিম রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের পাঁচখাইন গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাউজানে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন। তবে দলীয় কোনো পদ ছিল না তার। ভেষজপণ্যের ব্যবসার পাশাপাশি ছিল গরুর খামার। এছাড়া গত এক বছর ধরে কর্ণফুলী নদী থেকে বালু উত্তোলনের ব্যবসা করে আসছিলেন আবদুল হাকিম।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) তারেক আজিজ জাগো নিউজকে বলেন, হামলাকারীরা ২০-৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই গুলি করে পালিয়ে যায়। ঘটনার সময় পুলিশের একটি টহল টিম নজু মিয়া হাটে ছিল। তারা সেখান থেকে আসতে আসতে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।
তিনি বলেন, মদুনাঘাট তদন্ত কেন্দ্রের অন্য পুলিশ সদস্যরা ঘটনার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তারপরও আশপাশের সড়কে যানজট থাকায় তাদের পৌঁছাতে ৫-৭ মিনিট সময় লেগে যায়। পুলিশ পৌঁছাতে পৌঁছাতে আসামিরা পালিয়ে যায়।
অপরাধীদের গ্রেফতারের বিষয়ে জানতে চাইলে তারেক আজিজ বলেন, এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাকি আপডেট জানানো হবে।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ভুক্তভোগী পরিবারের কেউ মামলা করেননি। থানায় এখনো কোনো মামলা অ্যান্ট্রি হয়নি।
আবদুল হাকিমের ভাই মুহাম্মদ পারভেজ জানিয়েছেন, তার ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কারও শত্রুতা ছিল না। তিনি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন। কী কারণে তাকে হত্যা করা হলো তা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানান পারভেজ।
বিএনপির কর্মীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাতে রাউজানে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরা। হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও শাস্তি দাবি করে রাত সাড়ে ৮টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী রাউজান সদরের মুন্সিরঘাটা ও সূর্যসেন চত্বর, জলিলনগরসহ পাঁচ-ছয়টি স্থানে অবরোধ করা হয়।
অবরোধ চলাকালে টায়ার জ্বালিয়ে সড়কে অবস্থান নেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। পরে উপজেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্বাসে তারা অবরোধ তুলে নেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাউজানে গত ৫ আগস্টের পর সহিংসতায় মোট ১৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১০টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। বিএনপির দুপক্ষে সংঘর্ষ হয় অন্তত শতাধিকবার। এসব ঘটনায় অন্তত তিন শতাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হন।