বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্ত আজ ভয়ংকর মাদক বাণিজ্যের অন্ধকার জগতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন অভিনব কৌশলে ইয়াবা ও আইসসহ প্রাণঘাতী নানা মাদক দেশে প্রবেশ করছে। বিপরীতে পাচার হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, নির্মাণসামগ্রী, এমনকি কৃষকের জন্য ভর্তুকিপ্রাপ্ত সার ও কীটনাশকও। সীমান্তে কার্যত গড়ে উঠেছে এক ধরনের “পণ্য বিনিময় বাণিজ্য”, যেখানে মূল মুদ্রা হয়ে উঠেছে ইয়াবা।
রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেখানে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। খাদ্য ও অর্থাভাব চরম আকার ধারণ করেছে। এর সুযোগ নিয়ে সীমান্তের ওপারে গড়ে ওঠা শতাধিক ইয়াবা কারখানা এখন আর টাকা বা ডলারের বিনিময়ে নয়, বরং বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিনিময়ে মাদক সরবরাহ করছে। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে প্রবাহমান নাফ নদীর প্রস্থ প্রায় তিন কিলোমিটার। ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের দুর্গম এলাকায় এই কারখানাগুলো থেকে আসছে প্রতিদিন কোটি টাকার ইয়াবা। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আইস বা ক্রিস্টালের চালানও।
শুধু নদীপথ নয়, এখন সমুদ্রপথ হয়ে মাদক প্রবাহ আরও জোরালো হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নৌযান ব্যবহার করে পাচারকারীরা সেন্টমার্টিন দ্বীপ ঘুরে নিরাপদে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে সুযোগ বুঝে কক্সবাজার, বাঁশখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পটুয়াখালী, কুয়াকাটা ও চট্টগ্রাম উপকূলে ইয়াবার বড় বড় চালান নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর টহল আন্তর্জাতিক জলসীমায় সীমিত থাকায় এ পথ পাচারকারীদের কাছে এখন সবচেয়ে নিরাপদ।
টেকনাফের একজন প্রবীণ জনপ্রতিনিধি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের চোখের সামনে প্রতিদিন চাল, সার, সিমেন্ট, কৃষি উপকরণ পাচার হচ্ছে। বিনিময়ে আসছে ইয়াবা। এটা শুধু সীমান্তবাসীর সমস্যা নয়, পুরো জাতির জন্য এক সর্বনাশা পরিস্থিতি।”
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো কৃষির জন্য ভর্তুকিপ্রাপ্ত সার পাচার। দেশে যে ইউরিয়া সার প্রতি বস্তা ১ হাজার ৩৫০ টাকায় কৃষকরা পান, সেটি পাচার হয়ে মিয়ানমারে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার টাকায়। পাচারকারীরা বস্তাপ্রতি গড়ে ৩ হাজার ৬৫০ টাকা মুনাফা করছে। আর ওই সার যাচ্ছে আরাকান আর্মির হাতে। এর বিনিময়ে আসছে ইয়াবা ও আইস। চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক, কর্ণফুলী নদীর মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চল হয়ে নিয়মিত এই পাচার হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় থেকেও এ পাচার বন্ধ হচ্ছে না, বরং পাচারকারীরা তাদের ‘ম্যানেজ’ করেই ব্যবসা চালাচ্ছে। একজন কৃষক নেতা বলেন, “আমরা কৃষকেরা ন্যায্য মূল্যে সার পাচ্ছি না। অথচ দেশের সার পাচার হয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারে। এর বিনিময়ে আসছে ইয়াবা। এটা শুধু অর্থনীতির ক্ষতি নয়, পুরো জাতির ক্ষতি।”
র্যাব–১৫ এর সহকারী পুলিশ সুপার আ. ম. ফারুক জানান, নৌপথে মাদক পাচার বেড়েছে। সম্প্রতি কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর মোহনা থেকে চার লাখ ৬০ হাজার ইয়াবাসহ ৯ জনকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকায় পাচারের গতি কমছে না।
টেকনাফ–২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, “আমরা নাফ নদীতে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছি। আন্তর্জাতিক জলসীমায় টহল না থাকায় সেখানেই তারা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে।”
কোস্টগার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মো. সিয়াম–উল–হক জানিয়েছেন, “পাচারকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে খাদ্য, সার, সিমেন্ট, টাইলস, জ্বালানি তেল, শুঁটকি, চিংড়ি পোনা, কসমেটিকস, মোবাইল ফোনসহ নিত্যপণ্য মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে। এর বিনিময়ে দেশে প্রবেশ করছে ইয়াবা।”
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, “ট্রান্সন্যাশনাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই এই পাচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আগে ইয়াবা কেনাবেচায় টাকা বা স্বর্ণ ব্যবহৃত হলেও এখন চলছে পণ্যের বিনিময়ে লেনদেন।”
জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসি বলছে, দেশে যত মাদক প্রবেশ করে তার মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে।
ডিএনসির হিসাবে, বাংলাদেশ ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’ এবং ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’-এর মাঝামাঝি অবস্থান করায় আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের অন্যতম রুটে পরিণত হয়েছে। সীমান্তের ১৮ জেলার ১০৫টি পয়েন্টকে ইতোমধ্যে মাদকের প্রবেশ পথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অন্তত এক কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মাদকাসক্ত। বছরে এ খাতে খরচ হচ্ছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িত রয়েছে অন্তত দুই লাখ মানুষ। তাদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিবছর পাচার হয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
ডিএনসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদকের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যায় অন্তত ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সমান।
বিজিবির রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সীমান্তে শুধু নাফ নদী নয়, বিস্তীর্ণ সাগরপথকেও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে তথ্য আদান–প্রদান করা যেত, এখন সে সুযোগ নেই। তবু আমরা সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছি।”
মাদকবিরোধী সংগঠন ও স্থানীয় নাগরিক সমাজ বলছে, নিয়মিত অভিযান থাকলেও মূল হোতারা অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে। ধরা পড়ছে শুধু বাহক বা ছোট কারবারিরা। তাদের অভিযোগ, “অভিযানে গতি নেই। পুরোনো মাদক ব্যবসায়ীরা আবারও সক্রিয় হয়েছে। দ্রুত বিশেষ অভিযান না চালালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভয়াবহ প্রবাহ কেবল যুবসমাজকেই নয়, দেশের কৃষি অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করছে। প্রতিদিন ভর্তুকিপ্রাপ্ত সার পাচার হয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, কৃষক বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায্য মূল্যে সার থেকে, আর পাচারকারীরা লাভবান হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পড়ছে মাদকের মারাত্মক আসক্তির ফাঁদে।
স্থানীয় সচেতন রাজনীতিবিদের মতে, শুধু নিয়মিত রুটিন অভিযান দিয়ে এই প্রবাহ ঠেকানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সীমান্তজুড়ে সমন্বিত নজরদারি, প্রশাসনের ভেতরের দুর্নীতি দমন এবং মূল হোতাদের বিচারের মুখোমুখি করা। সময় থাকতেই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ইয়াবা ও আইসের এই মরণব্যাধির মতো স্রোতে পুরো প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে।